সমবায় সমিতি কি? এর উদ্দেশ্য ও কার্যাবলী

সমবায় সমিতি কি?এর উদ্দেশ্য

গ্রামীণ অর্থনৈতিক অবকাঠামো উন্নয়নে সমবায় সমিতি এর গর্ব করার মত সুদীর্ঘকালের ঐতিহ্য এবং ইতিহাস রয়েছে। ১৮২১ সালে রবার্ট ওয়েন ইংল্যান্ডের ‘নিউ লানার্ক’ নামক শহরে এবং তার আশেপাশের শ্রমিকদের একত্রিত করে সমবায় গ্রাম প্রতিষ্ঠা করেন। রবার্ট ওয়েন যেহেতু আধুনিক সমবায়ের কাঠামোগত ভিত রচনা করেছিলেন তাই তাঁকে ‘আধুনিক সমবায়ের জনক’ (Father of Modern Cooperatives) বলা হয়।

সমবায় সমিতি কি?

সমবায় সমিতি হলো একটি সামাজিক বা আর্থিক সংগঠন যা তার সদস্যদের সামাজিক বা আর্থিক উন্নতির জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। এই সমিতিগুলি সাধারণভাবে আপনার পছন্দের উপর ভিত্তি করে হয়ে থাকে ও সদস্যদের সাহায্যের মাধ্যমে সম্ভলিত প্রচেষ্টায় উন্নতির লক্ষ্যে কাজ করে।

এই সমিতির মূল উদ্দেশ্য হলো সদস্যদের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করা, একে অপরের সাহায্য করা, এবং সামাজিক অথবা আর্থিক সমস্যার সমাধানে একত্রিত হওয়া। এই সমিতির ব্যবস্থাপনা বা যাবতীয় নির্দেশাবলী সাধারণভাবে সমবায় আইন ও নীতির আওতায় থাকে।

সমবায় সমিতির প্রধান উদ্দেশ্য কি?

সমিতির উদ্দেশ্য:- সমবায়ের মাধ্যমে সংগঠিত করে পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে সমবায় সংগঠন ভিত্তিক পরিকল্পিত জীবন যাপনের লক্ষ্যে সমিতির সদস্যদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সঞ্চয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে সদস্যদের এবং সমষ্টিগতভাবে সমিতিকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী করে গড়ে তুলে সমিতির সদস্যদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

সমবায় সমিতির প্রকারভেদ:-

সমাজের স্বল্প আয় বিশিষ্ট সাধারণ জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক কল্যাণধর্মী যৌথ প্রচেষ্টার সংগঠন হচ্ছে সমবায় সংগঠন। বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ তাদের প্রয়োজন মেটাবার লক্ষ্যে নানাধর্মী সমবায় সংগঠন গড়ে তুলতে পারে। এ কারণে সমাজে বিচিত্ৰ ধর্মী সমবায় সংগঠন দেখতে পাওয়া যায়। নিম্নে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিন্যাসকৃত প্রকারভেদ দেখানো হলো।

ক. সদস্যদের চাহিদা অনুসারে সমবায় সমিতি :-

১. উৎপাদক সমবায় সমিতি (Producers cooperative society): –

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্পের মালিক ও উৎপাদকগণ বৃহদায়তন শিল্পগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য তাদের স্বল্প অর্থকে একত্রিত করে যে সমবায় গঠন করে তাকে উৎপাদক সমিতি বলে।

কোনো এলাকায় কিছু শ্রমিক একত্রে মিলে কোনো উৎপাদন শুরু করলে বা কতিপয় ব্যক্তি সমবায়ের ভিত্তিতে কোনোরূপ উৎপাদন কাজের সাথে জড়িত হয়। তাঁতিদের সমবায়, দুগ্ধ উৎপাদন সমবায় ইত্যাদি এ জাতীয় সমিতির উদাহরণ।

২. ভোক্তা সমবায় সমিতি (Consumers cooperative society): –

যখন কোনো বিশেষ পণ্যের বা কতিপয় পণ্যের ভোক্তাগণ মধ্যস্থব্যবসায়ীর মুনাফার শিকার না হয়ে কম মূল্যে জিনিস কিনতে চান তখন তাদের চাহিদা পূরণে যে সমবায় প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়।

এই প্রতিষ্ঠান উৎপাদনকারী, আমদানিকারক বা পাইকারের নিকট থেকে পাইকারি মূল্যে পণ্যসামগ্রী খরিদ করে সেসব পণ্য সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্যের নিকট ন্যায্য মূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে থাকে।

ভোক্তা এই সমিতিকে বণ্টনকারী সমবায় সমিতি নামেও অভিহিত করা হয়।

খ. উদ্দেশ্য বা কার্যের প্রকৃতি অনুসারে :-

১. ক্রয় সমবায় সমিতি (Purchasing cooperative society):-

বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ এই সমিতির মাধ্যমে সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি, যেমন- পণ্য-দ্রব্য, কাঁচামাল, বীজ, সার, যন্ত্রপাতি ইত্যাদি সংগ্রহের জন্য ক্রয় সুবিধা গ্রহণ করে।

সাধারণ ভাবে স্থানীয় ভিত্তিতে এ সমবায় সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সংগঠন সরাসরি উৎপাদকের বা তাদের প্রতিনিধির নিকট থেকে পাইকারি হারে প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করে।

২. বিক্রয় সমবায় সমিতি (Marketing cooperative society: –

ক্ষুদে উৎপাদক, কৃষক ইত্যাদি শ্রেণির লোকজন তাদের পণ্যদ্রব্য বিক্রয়, গুদামজাতকরণ, পরিবহন ইত্যাদি ব্যাপারে পাইকারি সুবিধা প্রাপ্তির লক্ষ্যে যদি কোনো সমবায় সংগঠন গঠন করে তবে তাকে উক্ত সমিতি বলে।

৩. আমদানি সমবায় সমিতি (Import cooperative society): –

ক্ষুদে আমদানিকারকগণ তাদের নানাবিধ সুবিধা ও সরকারের কাছ থেকে দাবি আদায়ের নিমিতে যে সমবায় গঠন করে তা আমদানি সমিতি নামে পরিচিত

৪. রপ্তানি সমবায় সমিতি (Export cooperative society): –

ক্ষুদ্র রপ্তানিকারকগণ রপ্তানি বিষয়ে পাইকারি সুবিধা, সম্মিলিত অভিজ্ঞতা ও সরকারের নিকট হতে দাবি আদায়ের নিমিত্তে যদি সমবায় সমিতি গঠন করে তবে তাকে রপ্তানি সমিতি বলা হবে।

৫. বিমা সমবায় সমিতি (Insurance cooperative society): –

নিজেদের বিমা নিজেরা সংঘবদ্ধভাবে করার জন্য কোনো জনগোষ্ঠী যে সমিতি প্রতিষ্ঠা করলে তাকে বিমা সমিতি বলে।

৬. ব্যাংক সমবায় সমিতি (Bank cooperative society): –

ক্ষুদ্র ভিত্তিতে সদস্যদের নিকট হতে আমানত গ্রহণ ও তাদেরকে ঋণদানের জন্য যে সমবায় গড়ে ওঠে তাকে ব্যাংক উক্ত সমিতি বলে।

৭. ঋণদান সমিতি (Credit cooperative society): –

মহাজন বা ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের বদলে কম সুদে নিজেদের সঞ্চয় হতে ঋণ গ্রহণের জন্য যদি পেশাজীবীরা মিলিত হয়ে কোনো সমবায় গঠন করে।

৮. গৃহনির্মাণ সমিতি (Housing cooperative society): –

যদি মধ্যবিত্ত ও স্বল্পবিত্ত লোকেরা নিজেদের গৃহ নির্মাণের উদ্দেশ্যে কোনো সমবায় গড়ে তোলে তবে তাকেই গৃহ নির্মাণ সমবায় সমিতি বলা হয়।

৯. সমবায় আবাসিক এলাকা (Cooperative housing society): –

কোনো স্থানে আবাসিক প্লট খরিদের উদ্দেশ্যে যদি কোনো জনগোষ্ঠী একত্রিত হয় তবে তাকে সমবায় আবাসিক এলাকা বা আবাসিক এলাকাভিত্তিক সমবায় বলে।

১০. বহুমুখী সমবায় সমিতি (multi-purpose cooperative society): –

যখন কোনো সমিতি বিভিন্ন প্রকার ব্যবসায়িক কাজে লিপ্ত হয় তখন তাকে বহুমুখী সমিতি বলে। এরূপ সমিতি ক্রয়, বিক্রয়, গৃহ নির্মাণ, ব্যাংকিং বিমা এ ধরনের বহুমুখী কার্য সম্পাদন করে থাকে।

গ. সাংগঠনিক স্তর অনুসারে :-

১. প্রাথমিক সমবায় সমিতি (Primary cooperative society): –

এই সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যা সর্বনিম্ন স্তরে বা প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত হয়। সমবায় বলতে মূলত এ স্তরের সমবায়কেই বোঝানো হয়। ইউনিয়ন থেকে থানা পর্যায়ের সমিতি এর অন্তর্ভূক্ত।

২. কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি (Central cooperative society): –

কতগুলো প্রাথমিক সমিতির সম্মিলিত রূপ হচ্ছে কেন্দ্রীয় সমিতি। ইউনিয়ন বা থানা পর্যায়ের সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে এ জাতীয় সমিতি গঠিত হয়। এটি সমবায়ের দ্বিতীয় স্তর । এ সমিতিতে কোনো ব্যক্তি সদস্য হতে পারেনা।

৩. মিশ্র সমিতি (Mixed cooperative society): –

এটি সমবায়ের তৃতীয় স্তর। ব্যক্তি সদস্যের পাশাপাশি প্রাথমিক সমবায় সমিতিগুলো এর সদস্য হয়ে থাকে। বিভাগীয় পর্যায়ের সমবায় সমিতিগুলো একত্রিত হয়ে মিশ্র সমিতি গঠন করে।

৪. জাতীয় সমবায় সমিতি (National cooperative society): –

এটি সর্বোচ্চ স্তরের (চতুর্থ স্তর) সমবায় সংগঠন। জাতীয় পর্যায়ে যে সমিতি গঠন করা হয় তাকেই উক্ত সমিতি বলে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কার্যরত কেন্দ্ৰীয় সমবায় সমিতিগুলোর সমন্বয়ে এরূপ সমিতি গঠিত হয়।

ঘ. দায়দায়িত্বের প্রকৃতি অনুসারে (According to the liabilities): –

১. অসীম দায় সমবায় সমিতি (Unlimited cooperative society): –

অসীম দায় সমবায় সমিতি হচ্ছে সে ধরনের সমবায় সংগঠন যেখানে সদস্যদের দায় তাদের ক্রয়কৃত শেয়ার দ্বারা বা অন্য উপায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না। সমিতির দেনার জন্য এ জাতীয় সমিতির সদস্যরা এককভাবে এবং যৌথভাবে দায়ী থাকে।

২. সসীম দায় সমিতি (Limited cooperative society): –

সমিতির সদস্যদের দায় যখন তাদের ক্রয়কৃত শেয়ারের আংকিক মূল্য দ্বারা সীমাবদ্ধ থাকে । সদস্যদের সীমিত দায়কে বোঝাবার জন্য এরূপ সমিতির নামের শেষে লিমিটেড শব্দ যোগ করা হয়। দেশের অধিকাংশ সমবায়ই এ শ্রেণিভুক্ত।

উল্লিখিত সমিতিসমূহ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক চুক্তি ও নির্মাণ, কৃষি , অকৃষি , অ-ঋণদান সমিতি, শিল্প সংক্রান্ত সমিতি ইত্যাদি বহুবিধ সমবায় সমিতির অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়।

সমবায় সমিতি কেনো করবেন?

সমিতি গঠনের কারণ বা সম্বলিত হওয়ার, একটি বড় কারণ হলো এর মাধ্যমে সামাজিক এবং আর্থিক উন্নতি সাধন করা। এটি একটি সামাজিক মাধ্যম যা সদস্যদের একত্রিত করা এবং সামাজিক সুস্থতা ও উন্নত সমাজ গড়ার জন্য ব্যাপক সুযোগ প্রদান করে।

আর্থিক উন্নতি: এই সমিতি একটি উন্নত আর্থিক মডেল তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে, যাতে সদস্যরা সার্বজনিক উন্নতি অর্জন করতে সক্ষম হয় এবং একত্রে থাকতে পারে।

সমবায়ে সামাজিক এবং ভৌতত্ত্বিক উন্নতি: সমবায় সমিতি একটি সামাজিক নেটওয়ার্ক তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে যাতে সদস্যরা একে অপরকে সাহায্য করতে পারে এবং সমাজে বন্ধন অটুট থাকে।

সামাজিক সমস্যা সমাধান: সমবায় সমিতির মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা সমাধান করা যায়, এমনকি অর্থনৈতিক সমস্যাও, অনেকাংশে সমাধান করা যায়।

ভৌতত্ত্বিক উন্নতি: একটি সমবায় সমিতি বিশেষভাবে যোগাযোগ ও ব্যবস্থাপনা বা প্রচার মাধ্যমকে শক্তিশালি করে।

সমিতি গঠনের মাধ্যমে সদস্যরা একে অপরের সাথে একত্রে থাকতে পারে, আর্থিক উন্নতি করতে পারে, সামাজিক মূল্যবোধ বাড়ে, পারস্পরিক সম্পর্ক শক্ত হয়, শিক্ষার প্রসার প্রসারিত হয়। সামাজিক ও আর্থিক ভাবে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।

বাংলাদেশের সমবায় নীতিমালা

বাংলাদেশের যে কোনো সমবায় সংগঠন সাধারণত ৭টি নীতিমালা অনুসরণ করে:

১. স্বতঃস্ফূর্ত এবং অবাধ সদস্যপদ

২. সদস্যের গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ

৩. সদস্যের আর্থিক অংশগ্রহণ

৪. স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা

৫. শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং তথ্য

৬. আন্তঃসমবায় সহযোগিতা

৭. সামাজিক অঙ্গীকার।

সমবায় সমিতি কার্যাবলি

প্রথমত – সমবায় নীতিতে উদ্বুদ্ধকরণ ও নিবন্ধন প্রদান।

 দ্বিতীয় – সমবায় নিরীক্ষা, পরিদর্শন ও তদারকির মাধ্যমে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা।

তৃতীয় – সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মচারিদের প্রশিক্ষণ/উচ্চতর প্রশিক্ষণের সুযোগ সৃষ্টির মাধমে পেশাগত মানবৃদ্ধি করা।

চতুর্থ – সমবায় সদস্যবৃন্দকে প্রায়োগিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি এবং মূলধন সৃষ্টি ও আত্ম-কর্মসস্থানের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাস করা।

পঞ্চম – সমবায় নেটওয়ার্কিং জোরদার করার লক্ষ্যে সমবায় মূল্যবোধের প্রচার, প্রকাশনা, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করা।

ষষ্ঠ – পুঁজি গঠন ও বিনিয়োগের মাধ্যমে মূলধন সৃষ্টি এবং সমবায় ভিত্তিক ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা।

সপ্তম – সমবায় ভিত্তিক প্রকল্প ও কর্মসূচির মাধ্যমে গ্রামীণ মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন।

অষ্টম – সমবায় পণ্য ব্রান্ডিং ও বাজার সংযোগ প্রতিষ্ঠা করা।

নবম – অভিলক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় নীতিমালা, উন্নয়ন কর্মসূচি এবং উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা।