একজন গর্ভবতী মায়ের প্রতিদিনের খাবার তালিকা

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা
গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা ও সেবা তার আনাগত শিশুর স্বাস্থ্য ও সুখের জন্য অপরিহার্য। গর্ভাবস্থা একজন নারীর জীবনের এক অনন্য এবং স্মরণীয় সময়, এ সময়ে একজন নারীর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া জরুরী। 

এই সময়ে, সুস্থ খাবারের গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়। । জীবনের সব পর্যায়েই স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু গর্ভাবস্থায় এটা বিশেষভাবে জরুরি। সুষম খাবার আপনার সন্তানের বেড়ে ওঠা, তার বিকশিত হওয়া এবং সঠিক ওজন বজায় রাখতে সহায়তা করবে।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকাসেবা কেমন হবে?

পরিবারের নতুন সদস্যের কল্যাণের জন্য কীভাবে আপনার নিজের প্রতি যত্নশীল এবং খাবারে তালিকায় পরিবর্তন আনবেন, তা জানতে আমাদের সম্পূর্ন আর্টিকেলটি পড়ুন।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় সুষম খাদ্যাভ্যাস

গর্ভাবস্থায় সঠিক এবং সুষম খাবার খাওয়া অত্যন্ত জরুরী। পুষ্টিকর খাবার যেমন তাজা ফল, সবজি, পূর্ণ শস্য, প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার এবং যথেষ্ট পানি পান করা উচিত।

নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম

হালকা এবং নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম, যেমন হাঁটা ব্যায়াম, গর্ভাবস্থায় শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী।

পর্যাপ্ত বিশ্রাম

গর্ভাবস্থায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া অত্যন্ত জরুরী। নিয়মিত ঘুম এবং দিনে কিছু সময় বিশ্রাম নেওয়া শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।

নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা

গর্ভাবস্থায় নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা অত্যাবশ্যক। এটি মায়ের এবং শিশুর স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য জরুরী। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিক্ষা করাতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন

গর্ভাবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো, মানসিক চাপ কমানোর কৌশল অনুসরণ করা এবং প্রয়োজনে মনোবিজ্ঞানীর সাথে কথা বলা উচিত।

একজন গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা নিম্নরূপঃ

একজন গর্ভবতী মায়ের পুষ্টিকর খাবার তালিকা তখনই নিশ্চিত হয় যখন মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সবগুলো খাদ্য উপাদানযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার প্রতিদিনের খাবার তালিকায় থাকে। এবং এই স্বাস্থ্যকর খাবার একজন মায়ের ও তার অনাগত সন্তানের জন্য প্রয়োজনীয়তা আপরিসীম।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় ফলমূল –   টাটকা, হিমায়িত ও শুকনো সব ফলই ভালো। খাবারের সময় প্লেটের অর্ধেক থাকা উচিত ফলমূল ও সবজি।

 শাকসবজি– টাটকা, বা শুকিয়ে সংরক্ষণ করা শাকসবজি- এগুলোর যে কোনোটি আপনি খেতে পারেন। সালাদের জন্য পাতাওয়ালা গাঢ় সবুজ শাকসবজি । খাবারের সময় আপনার ফলমূল ও সবজি বেশি খেতে হবে।

 গ্রেইন্স বা শস্য – একজন গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় থেকে খাবারের প্লেটে যে সব খাবার দেওয়া হবে, তার মধ্যে এমন খাবার হতে হবে যা প্রক্রিয়াজাত নয় বরং খাদ্যশস্যের পুরোটা থেকে আসা যেমন- ওটস, বার্লি, কুইনোয়া (কাওনের চাল), ব্রাউন রাইস (ঢেঁকিছাঁটা চাল) ও লাল আটা।

 আমিষ – প্রতিদিন একজন গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা বিভিন্ন ধরনের আমিষযুক্ত খাবার রাখা গুরুত্বপূর্ণ। মাংস, পোল্ট্রি, শিম, মটরশুঁটি, ডিম, বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার- এগুলোর সবই আমিষসৃমদ্ধ খাবার।

ডেইরি – ডেইরি পণ্য বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অবশ্যই দেখে নিতে হবে সেগুলো যেন পাস্তুরিত হয়। দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য যেমন পনির, দই এগুলো ভালো খাবার।

তেল ও ফ্যাট (স্নেহ) – স্নেহজাতীয় খাবারের ক্ষেত্রে প্রাণিজ ফ্যাট খাওয়াটা সীমিত করতে হবে। স্বাস্থ্যকর ফ্যাট অন্যান্য খাবারে পাওয়া যায় যেমন, কিছু মাছ, ও বাদাম। খাবারে তেল আসে মূলত উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে (যেমন অলিভ ওয়েল ও ক্যানোলা ওয়েল)।

আয়রন – প্রতিদিন ২৭ মিলিগ্রাম আয়রন গ্রহণের চেষ্টা করুন। আয়রন আপনার শরীরের লোহিত রক্ত কণিকাকে গর্ভে বাড়তে থাকা সন্তানকে অক্সিজেন সরবরাহে সহায়তা করবে। আপনি এটা পাবেন চর্বিহীন মাংস (রেড মিট), পোল্ট্রি, মটরশুঁটি ও শিমে।

প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার

প্রোটিন হলো গর্ভবতী মায়েদের ডায়েটের একটি অপরিহার্য অংশ। মাংস, মাছ, ডিম, ডাল, বাদাম – এগুলো প্রোটিনের ভালো উৎস। তবে, রান্নার সময় স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি অনুসরণ করা উচিত।

কার্বোহাইড্রেট

কার্বোহাইড্রেট শক্তির মূল উৎস। আপনার ডায়েটে ভাত, রুটি, পাস্তা, আলু এবং শস্য রাখা উচিত। তবে, সাদা রুটি এবং পাস্তার পরিবর্তে সম্পূর্ণ শস্য জাতীয় খাবার বেছে নেওয়া ভালো।

ক্যালসিয়াম

ক্যালসিয়াম হাড়ের গঠন এবং শক্তির জন্য অপরিহার্য। দুধ, পনির, দই, এবং সবুজ পাতাবাহারী সবজি ক্যালসিয়ামের ভালো উৎস।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় আয়রন এবং ফোলেট

আয়রন রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরির জন্য জরুরী, এবং ফোলেট শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে সাহায্য করে। গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় মাংস, মাছ, সবুজ শাক-সবজি, ও ফোর্টিফাইড শস্য আয়রন এবং ফোলেটের ভালো উৎস।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় কোন কোন ভিটামিন ও খনিজ দরকার?

ভিটামিন ‘এ’– গাজর, মিষ্টি আলু এবং সবুজ পাতাওয়ালা শাকসবজি- এগুলোর সবকিছুতেই ভিটামিন ‘এ’ থাকে। ভিটামিন ‘এ’ আপনার সন্তানের হাড়ের বেড়ে ওঠা, দৃষ্টিশক্তি তৈরি ও ত্বকের বিকাশের জন্য প্রয়োজন। প্রতিদিন আপনাকে ৭৭০ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘এ’ গ্রহণ করতে হবে।

 ভিটামিন ‘সি’- গর্ভের সন্তানের মাড়ি, দাঁত ও হাড়ের বিকাশের জন্য প্রতিদিন আপনার ৮৫ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণ করতে হবে। লেবু, কমলা, জাম্বুরার মতো বিভিন্ন সাইট্রাস ফল, ব্রোকলি, টমেটো ও স্ট্রবেরিতে ভিটামিন ‘সি’ থাকে।

ভিটামিন ‘ডি’– সূর্যের আলো, ফোরটিফাইড মিল্ক (এক্সট্রা ভিটামিন ও খনিজ যুক্ত দুধ), স্যামন ও সার্ডিনের মতো চর্বিসমৃদ্ধ মাছ- এগুলো আপনাকে প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ৬০০ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিট ভিটামিন ‘ডি’ পেতে সহায়তা করবে। ভিটামিন ‘ডি’ আপনার শিশুর হাড় ও দাঁত গঠন এবং ভালো দৃষ্টিশক্তি ও ত্বকের বিকাশে সহায়তা করবে।


ভিটামিন ‘বি৬’

ভিটামিন ‘বি৬’ আপনার শিশুর লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে সহায়তা করবে। গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় প্রতিদিন ১.৯ মিলিগ্রাম ভিটামিন ‘বি৬’ গ্রহণ করতে হবে। গরুর মাংস, হোল গ্রেইন সিরিল ও কলা ভিটামিন ‘বি৬’ এর ভালো উৎস।

ভিটামিন ‘বি১২’

আপনার গর্ভের সন্তানের স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ এবং লোহিত রক্ত কণিকা তৈরিতে ভিটামিন ‘বি১২’ গুরুত্বপূর্ণ। মাছ, মাংস, পোল্ট্রি ও দুধ ভিটামিন ‘বি১২’ এর উৎস। প্রতিদিন আপনাকে ২.৬ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন ‘বি১২’ গ্রহণ করতে হবে।

ফলিক এসিড

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকা ফলিক এসিড বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই বি ভিটামিন শিশুর মস্তিষ্ক ও মেরুদণ্ডের জন্মগত ত্রুটি এড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে এবং এটা ভ্রুণ ও প্ল্যাসেন্টার বৃদ্ধি ও বিকাশে সহায়তা করে। বাদাম, গাঢ় সবুজ পাতাওয়ালা শাকসবজি, শিম ও কমলা লেবুর রস প্রতিদিনের প্রয়োজনীয় ৬০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক এসিড পেতে সহায়তা করবে। যদিও এই পরিমাণ ফলিক এসিডের চাহিদা পূরণের জন্য শুধু খাবার যথেষ্ট নয়।   

জল এবং তরল

পানি এবং অন্যান্য তরল পান করা গর্ভাবস্থায় খুবই জরুরী। প্রতিদিন অন্তত ৮-১০ গ্লাস পানি পান করা উচিত।

গর্ভবতী মায়ের খাবার তালিকায় কোন কোন খাবার এড়িয়ে চলা উচিত?

গর্ভবতী মায়েদের নির্দিষ্ট কিছু খাবার থেকে অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। আর তা গর্ভধারণ সংক্রান্ত জটিলতা তৈরি করতে পারে। গর্ভধারণকালে আপনাকে যেসব খাবার এড়িয়ে চলতে হবে:

  • কাঁচা, পাস্তুরায়ন ছাড়া দুধ এবং ওই ধরনের দুধ থেকে তৈরি কোমল পনির। এগুলোতে লিসটেরিয়া নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে, যা লিসটেরিওসিস নামের এক ধরনের রোগ তৈরি করতে পারে।
  • মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার। কারণ সেগুলোতে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
  • কাঁচা ও পুরোপুরি রান্না না হওয়া মাংসজাত পণ্য ।
  • কাঁচা মাছ ও সিফুড। কারণ এগুলোতে উচ্চমাত্রায় ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবী থাকতে পারে।
  • কিছু মাছে উচ্চ মাত্রায় পারদ (মার্কারি) থাকে এবং এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। বেশির ভাগ শিকারি মাছ যেমন হাঙ্গর, সোর্ড ফিশ, মার্লিন ও কিং ম্যাককেরেলে মার্কারি বেশি থাকে।
  • স্মোকড কিন্তু রান্না না করা মাছ যেমন, স্মোকড স্যালমন।
  • রান্না না করা অঙ্কুরিত বীজ, খাদ্যশস্য ও শিম। কাঁচা মূলা, শিম ও আলফালফার বীজ এবং রেডি-টু-ইট সালাদ এসব খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
  • কাঁচা বা কম সিদ্ধ ডিম। এতে সালমোনিলা ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
  • যকৃত (লিভার) ও অন্যান্য অঙ্গের মাংস। যকৃতে প্রচুর পরিমাণে আয়রন থাকলেও এটা গর্ভধারিণী নারীদের খেতে বলা হয় না। কারণ এতে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে এবং এই মাংসে বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে।