শেয়ার বাজার কি? এর ধরন ও কৌশল

শেয়ার বাজার

শেয়ার বাজার এমন একটি শব্দ যা আমরা প্রতিনিয়ত শুনে থাকি । দিনের শুরুতেই খবরের কাগজের প্রথম পাতায় কিংবা টেলিভিশন এর শিরোনামে আমরা সবসময়ই দেখে থাকি। এটি এমন একটি জনপ্রিয় ব্যবসা যা যেকোন পেশার মানুষ সহজেই ঘরে বসে করতে পারেন।

 শেয়ার বাজার কি?

শেয়ার বাজার হল একটি পাবলিক মার্কেট, যেখানে কোম্পানির শেয়ার বা স্টক কেনা-বেচা হয়। এই শেয়ার হল কোনো কোম্পানির মালিকানার একটি অংশ, এবং বিনিয়োগকারীদের এই শেয়ার কেনা-বেচা করার একটি প্ল্যাটফর্ম প্রদান করে।

এটি কিভাবে কাজ করে?

শেয়ার বাজার একটি রহস্যের নাম। এটি কারো জিবনে আশির্বাদ হিসেবে দেখা দিয়েছে অন্যদিকে কাউকে বানিয়ে দিয়েছে সর্বস্বান্ত ।চলুন জেনে নেই মূলত এই রহস্যময় বাজার মূলত কিভাবে কাজ করে।

কোম্পানি এবং আইপিও

একটি কোম্পানি যখন বড় হওয়ার জন্য তার পরিকল্পনা সাজায়, তখন তারা পাবলিকের কাছে শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (IPO)। আইপিও এর মাধ্যমে কোম্পানি প্রথমবারের মতো তার শেয়ার জনগনের কাছে বিক্রি করে এবং তার নাম তালিকাভুক্ত করে।

বিনিয়োগকারী এবং ট্রেডিং

শেয়ার বাজারে, বিনিয়োগকারীরা কোম্পানির শেয়ার কেনা-বেচা করে থাকেন। এই কেনা-বেচার প্রক্রিয়াটি হল ট্রেডিং, এবং এটি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে – দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক বা আরো দীর্ঘমেয়াদী। বিনিয়োগকারীরা তাদের বিনিয়োগের উপর লাভ অর্জন করার আশায় এই ট্রেডিং করে থাকে।

শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা

শেয়ার বাজারের উপর নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য প্রতিটি দেশে আলাদা আলাদা নিয়ন্ত্রণ সংস্থা থাকে। বাংলাদেশে, এর নাম হল বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC)। এই সংস্থাগুলো বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে এবং বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষা প্রদান করে।

শেয়ার বাজারের বিভিন্ন ধরন

শেয়ার বাজারের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে ধারনা রাখা আমাদের বিনিয়োগের পথচলায় অনেক এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। শেয়ার বাজারের এই বিভিন্ন ধরন বিনিয়োগকারীদের সঠিক স্টক বাছাই, ঝুঁকি মূল্যায়ন এবং লাভের সম্ভাবনা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।

১. প্রাইমারি মার্কেট (Primary Market)

প্রাইমারি মার্কেট হল সেই বাজার, যেখানে কোম্পানিগুলো প্রথমবারের মতো তাদের শেয়ার বিক্রি করে। এই প্রক্রিয়াটি আমরা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং (IPO) নামে চিনি। নতুন কোম্পানিগুলো বা যে কোম্পানিগুলো প্রথমবারের মতো শেয়ার বাজারে আসে, তারা প্রাইমারি মার্কেটের মাধ্যমে তাদের শেয়ার বিক্রি করে।

২. সেকেন্ডারি মার্কেট (Secondary Market)

সেকেন্ডারি মার্কেট হল সেই বাজার, যেখানে ইতিমধ্যে প্রকাশিত বা বিক্রি হওয়া শেয়ারগুলো বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কেনা-বেচা হয়। এই বাজারে, বিনিয়োগকারীরা একে অন্যের কাছ থেকে শেয়ার কিনে নিতে পারেন। এখানে, কোম্পানির সাথে সরাসরি লেনদেন হয় না। সেকেন্ডারি মার্কেটের উদাহরণ হল ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ।

৩. তালিকাভুক্ত এবং অতালিকাভুক্ত বাজার (Listed and Unlisted Market)

তালিকাভুক্ত বাজার: এখানে যেসব কোম্পানির শেয়ার বিক্রি হয়, সেগুলো একটি বিশেষ স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত হয়ে থাকে। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো নির্দিষ্ট নিয়ন্ত্রণ এবং স্বচ্ছতা মানদণ্ড মেনে চলে।

অতালিকাভুক্ত বাজার: এখানে কোম্পানিগুলো কোনো স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাভুক্ত না হয়ে থাকে। এই ধরনের বাজারকে অফার-দ্য কাউন্টার (OTC) বাজার বলা হয়।

৪. বুল এবং বিয়ার মার্কেট (Bull and Bear Market)

বুল মার্কেট: যখন বাজারে শেয়ারের দাম বাড়তে থাকে এবং অর্থনৈতিক উন্নতির একটি সাধারণ প্রবণতা দেখা যায়, তখন তাকে বুল মার্কেট বলে।

বিয়ার মার্কেট:  বিয়ার মার্কেট একটি শব্দ যা শেয়ার বাজারের একটি অবস্থা বোঝায়, যেখানে মূল্যের পতন হয় এবং একটি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল হয়। এই ধরনের বাজারে, বিনিয়োগকারীরা সাধারণত ভবিষ্যতে শেয়ারের দাম আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা করেন, যা আরো বিক্রয়ের চাপ সৃষ্টি করে এবং মূল্যের আরো পতন ঘটায়।

এই বিভিন্ন ধরনের বাজার বিনিয়োগকারীরা যাতে তাদের বিনিয়োগের স্ট্র্যাটেজি সাজাতে পারে তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করে। প্রতিটি বাজারের বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা বুঝে তার পর বিনিয়োগ করা, বিনিয়োগের সাফল্যের চাবিকাঠি।

বাংলাদেশে কোথায় কোথায় শেয়ার মার্কেট রয়েছে?

বাংলাদেশে মূলত দুটি প্রধান শেয়ার মার্কেট রয়েছে, যেগুলো হল:

১. ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (DSE) শেয়ার বাজার

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের প্রধান এবং পুরানো শেয়ার বাজার। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি মূল স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে আসছে। DSE ঢাকায় অবস্থিত এবং এটি দেশের বৃহত্তম শেয়ার মার্কেট।

২. চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (CSE) শেয়ার বাজার

চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান শেয়ার মার্কেট। ১৯৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত, এটি চট্টগ্রামে অবস্থিত। CSE বিশেষ করে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিনিয়োগকারীদের আর্থিক বাজারে অংশগ্রহণের একটি প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে।

এই দুই স্টক এক্সচেঞ্জ ছাড়াও বাংলাদেশে অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও মার্কেট রয়েছে যেগুলো আর্থিক সেবা প্রদান করে থাকে, কিন্তু শেয়ার মার্কেট হিসেবে এই দুইটি হল প্রধান এবং সর্বাধিক পরিচিত। এই দুই স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে, বিনিয়োগকারীরা কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে নিতে পারেন এবং তাদের আর্থিক পোর্টফোলিও বৃদ্ধি করতে পারেন।

শেয়ার বাজার বিভিন্ন টার্ম

শেয়ার বাজারের আলোচনায় বিভিন্ন টার্ম প্রায়ই উঠে আসে, যা বিনিয়োগকারীদের বাজারের গতিপ্রকৃতি এবং তার বিভিন্ন উপাদানগুলি বুঝতে সাহায্য করে। নিচে কিছু প্রধান শেয়ার বাজার টার্ম এর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:

১. শেয়ার (Share):

শেয়ার হল কোনো কোম্পানির মালিকানার একটি ইউনিট। এটি কোম্পানির মোট মূলধনের একটি অংশ প্রতিনিধিত্ব করে।

২. স্টক (Stock):

শেয়ার বাজারে “স্টক” বলতে বোঝায় কোনো কোম্পানির মালিকানার একটি অংশ, যা সেই কোম্পানিটির শেয়ারহোল্ডার বা স্টকহোল্ডারদের দ্বারা ক্রয় বা বিক্রয় করা যায়। স্টক কেনার মাধ্যমে একজন বিনিয়োগকারী সেই কোম্পানির একটি অংশীদার হয়ে যান, এবং এর মানে তিনি কোম্পানির মুনাফা, ডিভিডেন্ড পেমেন্ট, এবং কোম্পানির সাধারণ সভায় ভোট দানের মতো বিভিন্ন অধিকার পান।

৩. বাজার মূল্য (Market Price):

বাজার মূল্য হল একটি শেয়ারের বর্তমান মূল্য, যা বাজারে ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে হওয়া লেনদেনের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়।

৪. ডিভিডেন্ড (Dividend):

ডিভিডেন্ড হচ্ছে একটি কোম্পানি তার লাভের একটি অংশ যা তার শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিতরণ করে। এটি শেয়ারহোল্ডারদের কোম্পানির মুনাফায় অংশীদার করার একটি উপায়। ডিভিডেন্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস দ্বারা নেওয়া হয় এবং এটি সাধারণত নগদ অর্থে প্রদান করা হয়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত শেয়ার হিসেবে ডিভিডেন্ড দেওয়া হয়।

৫. আইপিও (IPO):

আইপিও বা ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিং হল একটি কোম্পানির প্রথম পাবলিক শেয়ার ইস্যু করার প্রক্রিয়া, যা কোম্পানিকে পাবলিক থেকে অর্থ সংগ্রহে সাহায্য করে।

৬. পোর্টফোলিও (Portfolio):

শেয়ার বাজারে “পোর্টফোলিও” শব্দটি বিনিয়োগকারীর দ্বারা মালিকানাধীন সকল বিনিয়োগের সমষ্টিকে নির্দেশ করে। এটি বিভিন্ন ধরণের আর্থিক সম্পদ, যেমন শেয়ার, বন্ড, মিউচুয়াল ফান্ড, এবং অন্যান্য সিকিউরিটিজের একটি সংকলন হতে পারে। একজন বিনিয়োগকারীর পোর্টফোলিও তার বা তার বিনিয়োগের লক্ষ্য, ঝুঁকি সহনশীলতা, এবং মেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী গঠিত হয়।

৭. লিকুইডিটি (Liquidity):

লিকুইডিটি হল একটি সম্পদকে দ্রুত এবং কম খরচে নগদে পরিণত করার ক্ষমতা। উচ্চ লিকুইডিটি মানে শেয়ারগুলি সহজেই বিক্রি বা কেনা যায়।

৮. ভলিউম (Volume):

শেয়ার বাজারে “ভলিউম” শব্দটি ব্যবহৃত হয় বাজারে কেনা-বেচার মাত্রা বোঝাতে। সহজ কথায়, এটি নির্দিষ্ট একটি সময়ের মধ্যে কোনো নির্দিষ্ট শেয়ার বা সিকিউরিটির কতগুলি ইউনিট কেনা বা বিক্রি হয়েছে তার সংখ্যা। ভলিউম বাজারের সক্রিয়তা এবং আগ্রহের একটি প্রধান সূচক হিসেবে কাজ করে। উচ্চ ভলিউম দেখায় যে ওই শেয়ারে বা সিকিউরিটিতে ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে, যা সাধারণত মূল্য পরিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত হয়।এই টার্মগুলি শেয়ার বাজারের বিভিন্ন দিক এবং প্রক্রিয়াকে বুঝতে সাহায্য করে, এবং বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মূল্যবান হতে পারে।

বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের অবস্থা ও সম্ভাবনা

শেয়ার বাজার একটি গতিশীল এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশ যেখানে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সামাজিক ফ্যাক্টরগুলো বাজারের দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করে। এখানে কিছু মূল পয়েন্ট দেওয়া হলো যেগুলো বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে একটি ধারণা দেবে: 

বৃদ্ধির প্রবণতা: সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বাংলাদেশের শেয়ার বাজার স্থিতিশীল বৃদ্ধি এবং প্রসারণের প্রমাণ দিয়েছে। অর্থনীতির বৃদ্ধির হার, বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নতি, এবং সরকারের পক্ষ থেকে উৎসাহিতকরণ এই বৃদ্ধির পেছনে মূল কারণগুলো।

বিনিয়োগের বৈচিত্র্য: বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে বিভিন্ন সেক্টরের কোম্পানি, যেমন টেলিকমিউনিকেশন, ফার্মাসিউটিক্যালস, ব্যাংকিং, ও পাওয়ার, তাদের শেয়ার প্রদান করে, যা বিনিয়োগকারীদের বৈচিত্র্যময় পোর্টফোলিও গঠনে সাহায্য করে।

ডিজিটালাইজেশন: ট্রেডিং প্রক্রিয়া, বিনিয়োগের তথ্য প্রাপ্তি, এবং স্টক মার্কেটের শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলো একটি বড় ভূমিকা পালন করছে।

শেয়ার বাজার এর সম্ভাবনা:

অর্থনৈতিক উন্নতি:

বাংলাদেশের অর্থনীতির স্থিতিশীল বৃদ্ধির হার এবং মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য শেয়ার বাজারের ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলেছে।

বৈশ্বিক বিনিয়োগ:

বাংলাদেশের বাজারে বৈশ্বিক বিনিয়োগের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা শেয়ার বাজারের গভীরতা ও প্রসারণে অবদান রাখছে।

রেগুলেটরি উন্নতি:

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (BSEC) এর নিয়ন্ত্রণ এবং নীতিমালা উন্নতির মাধ্যমে শেয়ার বাজারের স্বচ্ছতা, দক্ষতা, এবং বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ানো হচ্ছে।

সারাংশে বলা যেতে পারে, বাংলাদেশের শেয়ার বাজারের বর্তমান অবস্থা ও সম্ভাবনা অর্থনৈতিক উন্নতি, বিনিয়োগের বৃদ্ধি, এবং রেগুলেটরি উন্নতিগুলোর উপর নির্ভর করে। অবশ্যই, বাজারে বিনিয়োগের আগে প্রযোজ্য ঝুঁকি বিবেচনা এবং যথাযথ গবেষণা প্রয়োজন।