প্রতি বছরের ১৪ এপ্রিল, বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ উদযাপিত হয়। এই দিনটি শুধু একটি তারিখের পরিবর্তন নয়, বরং এটি বাঙালির জীবনে নতুনের সূচনা, এক নতুন শুরুর দিন।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
এই উৎসবের সূত্রপাত মোঘল সম্রাট আকবরের শাসনামলে। ঐতিহাসিকরা বলেন, এই ক্যালেন্ডারের প্রচলনের পেছনের উদ্দেশ্য ছিল কর সংগ্রহের কাজকে আরো সহজ ও নিয়মিত করা। কিন্তু এই ব্যবহারিক সিদ্ধান্তটি পরবর্তীতে বাঙালির সাংস্কৃতিক প্রাণের অংশ হয়ে উঠেছে।
তবে বাংলা নববর্ষ যেভাবেই আসুক না কেন এখন তা বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। তাই পহেলা বৈশাখ এলেই সব বাঙালির প্রাণ বাংলা নববর্ষ বরণের আনন্দে আপনা আপনিই নেচে ওঠে। পহেলা বৈশাখ তাই পালিত হয় ব্যক্তিগত, ধর্মীয়, সাম্প্রদায়িক, শ্রেণিগত অবস্থানের উর্ধ্বে উঠে ‘মানুষ মানুষের জন্য- এই বিশ্বাসকে সমাজ জীবনের সর্বত্রছড়িয়ে দেওয়ার জন্য।
ওয়াহিদুল হক, সনজীদা খাতুন প্রমুখের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দালালদের রক্তচক্ষুউপেক্ষা করে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ পালনের সময় থেকে ছায়ানট প্রবর্তনায় রমনার বটমূলে যে পহেলা বৈশাখ শুরু হলো-তা আজ গ্রাম-বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে গেছে। তবে সামাজিক উৎসব হিসেবে নববর্ষ পালন শুরু হয় ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে।
পঞ্চাশের দশকে লেখক-শিল্পী-মজলিস ও পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ নববর্ষ উপলক্ষ্যে ঘরোয়াভাবে আবৃতি, সঙ্গীতানুষ্ঠান ও সাহিত্যসভার আয়োজন করত। সনজীদা খাতুনসহ অন্যান্যদের উদ্যোগে ছায়ানটের আয়োজনে কবিগুরুর ‘এসো হে বৈশাখ এসো এসো’ গানটি দিয়ে বাংলা বছরের প্রথম দিন সকালে নববর্ষের আবাহন শুরু হয়।
পহেলা বৈশাখ ও বাংলার সংস্কৃতি
পহেলা বৈশাখ হচ্ছে নাগরিক জীবনে একে অন্যের সাথে একটি সেতুবন্ধ। ব্যস্ত নগর কিংবা গ্রামীণ জীবন যেটাই বলা হোক না কেন, এই নববর্ষই বাঙালি জাতিকে একত্র করে জাতীয়তাবোধে। এ অনুষ্ঠান পরিণত হয় প্রত্যেকটি বাঙালির কাছে শিকড়ের মিলনমেলায়। ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি জাতি এই নববর্ষকে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
আসছে বাঙালির প্রাণের উৎসবের দিন। বছরের প্রথম দিনটি বাঙালিরই শুধু নয়, বাংলা ভাষাভাষী আদিবাসী ও নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকটি মানুষের জীবন-জগতে স্বপ্নময় নতুন বছরের শুভ সূচনা ঘটায়। জীর্ণ-পুরোনোকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করে বাঙালি জাতি।
পহেলা বৈশাখের গুরুত্ব
পহেলা বৈশাখ বাঙালি সমাজের জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং উৎসবপূর্ণ দিন। এটি বঙ্গবর্ষ হিসেবেও পরিচিত, যা প্রতি বছর বাংলা ক্যালেন্ডারের প্রথম দিন তথা ১৪ এপ্রিলে পালিত হয়। এটি বর্ষবরণের প্রথম দিন হিসেবে বাঙালি সমাজের লোকে একসঙ্গে আসে এবং নতুন দিনটি স্বাগত করে।
এ দিনে বাঙালি লোক নতুন বসন্তের আগমন ও উৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা অনুভব করে। সবার জন্য এক নতুন শুরু। লোকেরা নতুন জামা পরে, হাঁটে বিভিন্ন প্রজাপতি মেলা ও উৎসবে অংশ নেয়। সম্প্রতি এ দিনে বাঙালি সমাজের বিভিন্ন উৎসব এবং সাংস্কৃতিক আনুষ্ঠান আয়োজিত হয় এবং সমাজে তা একত্রে উৎযাবিত হয়। এ দিন বিশেষ করে বাঙালি ব্যবসায়ী ও কৃষকরা নিজেদের বাড়ি, দোকান এবং কাজস্থল এর নতুন সূচনা হয়।
সকালের শুরু: মঙ্গল শোভাযাত্রা
দিনের শুরুটা হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা দিয়ে। এই শোভাযাত্রা একটি বর্ণাঢ্য এবং সাংস্কৃতিক প্রদর্শনী, যেখানে মুখোশ এবং বিভিন্ন প্রতীকী আকারের বিশাল বিশাল পুতুল নিয়ে মিছিল করা হয়।
দিনের প্রাণ: উদযাপন ও প্রথা
দিনভর চলে নানা রকমের উৎসব। রাস্তাঘাটে বিভিন্ন শিল্প ও কারুকাজের স্টল, ঐতিহ্যবাহী বাঙালি খাবারের স্টলের সমারোহ দেখা যায়। পান্তা ভাত, ইলিশ মাছ, মিষ্টি – এসব খাবার বাঙালির এই দিনের অপরিহার্য অংশ।
সন্ধ্যার সাজ: সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
সন্ধ্যা নামলে শুরু হয় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নাচ, গান, কবিতা আবৃত্তি – এসবের মাধ্যমে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটে।
উৎসবের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্যই হলো একটি সামাজিক মিলন
পহেলা বৈশাখ শুধু একটি উৎসব নয়, এটি বাঙালির জীবনে সামাজিক মিলনের এক অনন্য সুযোগ। এই দিনে মানুষেরা তাদের ব্যস্ততা, বিভেদ ভুলে একটি আনন্দময় ও মিলনময় পরিবেশে মেতে উঠে।
পহেলা বৈশাখ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্যঃ
1.পহেলা বৈশাখ বাঙালির নববর্ষ, যা প্রতি বছর বৈশাখ মাসের ১ তারিখ পালন করা হয়।
2.এই দিনে, মানুষ নতুন জামাকাপড় পরে এবং আনন্দের সঙ্গে উৎসব উদযাপন করে।
3.বাঙালিরা পারিবারিক ও বন্ধুদের সঙ্গে মিলিত হয়ে বিভিন্ন রান্না করা ঐতিহ্যবাহী খাবার উপভোগ করে।
4.এই দিনের প্রধান আকর্ষণ হল মঙ্গল শোভাযাত্রা, যা বিশ্ববিদ্যালয় অব ঢাকা থেকে শুরু হয়।
5. এই দিনে, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাচ, গান এবং কবিতা পাঠ অনুষ্ঠিত হয়।
6. পহেলা বৈশাখ পৃথিবীর সকল বাংলাভাষী মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় একটি সর্বজনীন অনুষ্ঠান।
7. উৎসবমূখর এই দিনের সকালের খাবার হয়ে থাকে পান্তা ইলিশ।
8. পহেলা বৈশাখের দিনে মেয়েরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরিধান করেন।
9. প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ভারতে ১৫ এপ্রিল ও বাংলাদেশে ১৪ এপ্রিল পালন করা হয়। তবে এই তারিখ বছর সাপেক্ষে পরিবর্তন হলেও হতে পারে। এটি মূলত নির্ভর করে বাংলা বছরের প্রথম তারিখের উপর নির্ভর করে।
10. পহেলা বৈশাখ দিনটি উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্রামে-গঞ্জে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এই মেলায় পুতুল নাচ, সার্কাস, নাগরদোলা স্থান পায়।কোথাও কোথাও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয়।
নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময়ঃ
এই দিনে আমরা আমাদের যাবতীয় রাগ, অভিমান, সমাজের সব ধরনের বিভেদ ভুলে পারিবারিক ভাবে, মা-বাবা, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা বিনিময় জানাই। বেড়াতে যাই আমাদের প্রতিবেশীদের বাসাই, আমাদের আত্মীয় স্ব-জনদের বাসাই।
সর্বোপরি বলা যায় এটি বাঙালি জাতির ঐতিহ্যের প্রতিচ্ছবি
সব মিলিয়ে, পহেলা বৈশাখ হল বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আনন্দ এবং সামাজিক ঐক্যের এক অনন্য উৎসব। এই দিনটি বাঙালির জীবনে নতুনের শুরু, আশা ও সম্ভাবনার দিন হিসেবে পালিত হয়। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ আমাদের কে মনে করিয়ে দেয় যে, জীবন হল আনন্দের উৎসব, যেখানে প্রতিটি দিন নতুন করে উদযাপন করার মতো।
আশা করি এই আর্টিকেলটি পহেলা বৈশাখের উৎসবের রঙ, ঐতিহ্য এবং উদযাপনের এক সুন্দর চিত্র তুলে ধরতে পেরেছে। এই বিশেষ দিনটিতে বাঙালির হৃদয় যেমন আনন্দে ভরে উঠে, তেমনি আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি গর্ব ও সম্মান আরো দৃঢ় হয়। শুভ নববর্ষ!