খেওড়া গ্রাম মেহারী ইউনিয়ন
“কী যে তোমার চোখে লেখা আছে
দেখি যে তাই চেয়ে
ওগো খেয়ার নেয়ে!”
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “খেয়া” কবিতায় খেয়া ঘাটের মাঝির চোখে যাহাই খুঁজুক আমি খেয়া’র মাঝে খোঁজে বেড়াই খেওড়া গ্রামের নামকরণ।
কবি কাজী নজরুল ইসলামের
খেয়া-পারের তরণী কবিতায়ও খুঁজি প্রত্যাশিত শব্দের আদি অন্ত।
“যাত্রীরা রাত্তিরে হতে এল খেয়া পার,
বজ্রেরি তূর্যে এ গর্জেছে কে আবার
বৃথা ত্রাসে প্রলয়ের সিন্ধু ও দেয়া-ভার,
ঐ হলো পুণ্যের যাত্রীরা খেয়া পার।”
(অগ্নিবীণা)
আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার খেওড়া গ্রামের রয়েছে এক আধ্যাত্মিক পরিচয়। বিশ্বে মানবিক সম্প্রীতির দূত হিসাবে পরিচিত মা দেবী শ্রী শ্রী আনন্দময়ীর(১৮৯৬ -১৯৮২)জন্ম ভিটা ও আশ্রম এই গ্রামেই।ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু,প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে তাঁর অগণিত ভক্তকুল সৃষ্টি হয়।এছাড়াও অত্র গ্রামের সুনাম যেসকল জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিবর্গের দ্বারা ছড়িয়ে পড়ছে উনাদের মধ্যে শিক্ষাবিদ ও সমাজ সংস্কারক মরহুম আলহাজ্ব নূরুল হক(১৯৩৬–২০১৪), জনাব,প্রফেসর মোঃ ঈদ্রিস; জনাব,প্রফেসর ডক্টর তাজুল ইসলাম; সাবেক ইউ.পি. চেয়ারম্যান শরীফ এ কে এম শামসুল হক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব জনাব,নারায়ণ সাহা মনি উল্লেখযোগ্য।
এখানে রয়েছেঃ
১টি হাই স্কুল
২টি সরকারী প্রাইমারী স্কুল
১টি হাফেজিয়া মাদ্রাসা
১টি হাট/বাজার
৬টি মসজিদ
৭টি কবরস্থান
১টি মন্দির ও
১টি শ্মশান
এছাড়াও এখানে বেশকিছু ক্রীড়া,সাংস্কৃতিক ও সমাজ সেবামূল সংগঠন রয়েছে।এগুলোর মধ্যে
★আকাবা ফাউন্ডেশন ও
★লায়ন্স স্পোর্টিং ক্লাব
বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য।
প্রাচীনকালে এই অঞ্চলটি হরিকেন নামক জনপদের অংশ ছিল। বৌদ্ধ যুগে এ এলাকা ছিল সমতট রাজ্যভুক্ত। পরবর্তীকালে মুসলিম শাসনামলে এতদ অঞ্চল ৩টি পরগনায় বিভক্ত হয়।
কালক্রমে এই অঞ্চলটি ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদার মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের জমিদারের অংশে পরিণত হয়। এই জমিদারের চাকলা রৌশনাবাদ এষ্টেটের মোগড়া রাজকাচারী ও আখাউড়াস্থ তহশীল কাচারী ছিল বর্তমান আখাউড়া সদর থেকে ৫ কিলোমিটার দক্ষিণে। এই কাচারী দুটির মাধ্যমে এতদ অঞ্চলের জমিদারীর যাবতীয় খাজনাদি আদায়সহ জমিদারী ব্যবস্থা কার্যাদি পরিচালিত হত। মহারাজার জমিদারীর দ্বিতীয় রাজধানী ছিল কুমিল্লা।
কিন্তু ইংরেজ শাসনামলে অত্র অঞ্চল কসবা থানার অন্তর্গত ছিল। এই সময় একটি পুলিশ ফাঁড়ির মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালিত হত।
খেওড়া গ্রামের নামকরণঃ
ঐতিহাসিক তথ্য উপাত্ত থেকে পাওয়া যায় প্রাচীনকালে অত্র অঞ্চল ছিল জলমগ্ন যা কালিদহ সায়র বা কালিদাস সাগর নামে অভিহিত। আর এ কালিদহ সায়রের বুকে জেগে উঠা ছোটছোট চরগুলোতেই পরবর্তীতে আস্তে আস্তে জনবসতি গড়ে উঠে।ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার অন্তর্গত আজকের খেওড়া নামক ঐতিহাসিক গ্রাম খানা(কালিদহ সায়রের বুকে জেগে উঠা চর) একসময় নূরনগর পরগণার একটি ব্যস্ততম খেয়া ঘাট ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।বর্তমান ভারতের আগরতলা কিংবা ত্রিপুরা তথা নূরনগর পরগণা থেকে বরদাখাত পরগণার সাথে জল পথে যাতায়তের জন্য এ খেয়া ঘাট নদী বন্দর হিসাবে ব্যবহৃত হত।(কালিদহ সায়রের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে শেষ পরিচয় সর্পিলাকার রাজার খালের জলযানের খেয়া ঘাট হিসাবেও ইহা বহুকাল ব্যবহৃত হয়েছে।)গায়ের অশিক্ষিত আর অর্ধ শিক্ষিত মানুষের মুখে এ খেয়া ঘাটের উচ্চারণ শোনা যেত খেওয়া (খেওয়া পাড় বা খেওয়া ঘাট)।যা পরবর্তীতে খেওয়া থেকে খেওড়া নাম ধারন করে।
গবেষণায় জানা যায়,জলমহাল আর খেয়াঘাট তদারকি করার জন্য চাকলা রৌশনাবাদ এস্টেট এর মোগড়া রাজকাচারীর অধীনে এখানে উচু স্থানে বসানো হয় রাজচৌকি। এক সময় এই চৌকির পাশে গড়ে উঠে ফুল,ফল আর ফসলের বাগ(বাগান)।[লোকমুখে শোনা যায় কোন এক সময় এখানে বড় বড় গাছে আচ্ছাদিত গহীন জঙ্গল ছিল।রাতে তো দূরের কথা দিনের আলোতেও কেউ ভয়ে জঙ্গলে যেত না] এখান থেকে ফুল ফল আর সুগন্ধি শস্যাদি উপহার হিসাবে কিশোর মানিক্য বাহাদুরের রাজ দরবারে পেশ করা হত বলে চৌকির নাম হয় রাজার বাগ।পুরাতন দলিল দস্তাবেদ ঘেটেঘুটে জানা যায়,খেওড়া মৌজার রাজারবাগ তালুকের শেষ মালিকানা ছিল কৈলাস চন্দ্র দাস নামক এক তালুকদারের। ধারনা করা হয় তার অন্তত সাত পুরুষ আগে থেকেই পারিবারিক সূত্রে এ মালিকানা তিনি পেয়ে এসেছিলেন।খেওড়া গ্রামের সবচেয়ে বড় জলাধার”কৈলাস দীঘি” নামে তার স্মৃতি আজও বহন করে চলেছে।
তিনি অছি মাহমুদ নামক একজন মুসলিম ব্যক্তিকে অত্র তালুকের খাজনাদি পরিশোধের জন্য নিয়োগ দেন।১৯০৫ সালে ব্রিটিশ সরকার বঙ্গভঙ্গ করে। কিন্তু হিন্দুরা মনে করে এই বঙ্গভঙ্গ হলে হিন্দু জমিদাররা তাদের ক্ষমতা হারাবে, আর মুসলমানদের উন্নতি হয়ে যাবে। এই তত্ত্ব থেকে হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরোধীতা করতে থাকে। ঐ সময় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের নেতা ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্ল চাকীর নেতৃত্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উল্লাস কর দত্তও ছিলো। এ বিরোধীতায় ক্ষুদিরামের ফাঁসি হয়, উল্লাস কর দত্তকে দেয় আন্দামানে নির্বাসন।তখন বঙ্গে থাকা বহু হিন্দু পরিবার ভারতে পাড়ি জমায়।এই স্রোতের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে কৈলাস চন্দ্র দাস অছি মাহমুদের নিকট রাজারবাগ ও আশ পাশের অধিকাংশ ভূসম্পত্তির মালিকানা হস্তান্তর করে ভারতে চলে যান।
অন্য এক নির্ভরশীল তথ্যমতে জানা যায় অছি মাহমুদের পিতা একমাত্র মুসলিম ব্যক্তি যিনি কোন এক সময় স্বপরিবারে পাঁচ পুত্র
১।অছি মাহমুদ
২।সরব আলী
৩।মব আলী
৪।ছোবালী
৫।কাসেম আলী সহ
কসবা থানার দেলী গ্রাম থেকে প্রথম খেওড়া গ্রামে এসে বসতি স্থাপন করেন।ওনার পরবর্তী প্রজন্মসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে আসা প্রায় বিশটি গোত্রের এক অবিচ্ছেদ্য সামাজিক বন্ধন আজকের খেওড়া গ্রাম।
বিশেষ নোটঃ
♦খেয়া [খেয়া]
{(তৎসম বা সংস্কৃত শব্দ) ক্ষেপ>, (প্রাকৃত) খেঅ>}
১। নৌকাদি দ্বারা নদী পারাপার।
২। নদী পারাপারের নৌকা; গুদারা।
- ঘাট (বিশেষ্য পদ) পুকুর নদী প্রভৃতি জলাধারে অবতরণ স্থান।
- খেয়াঘাট (বিশেষ্য) যে স্থান থেকে নৌকাযোগে নদী পারাপার হওয়া যায় পারঘাট (প্রভু নি দেখিছ খেয়া ঘাটে-বিজয় গুপ্ত)।
- খেয়া কড়ি (বিশেষ্য) নদী পার হওয়ার জন্য দেয় মাশুল বা অর্থাদি
- খেয়া দেওয়া (ক্রিয়া) খেয়া নৌকায় পারাপার করা।
- খেয়া নৌকা, খেয়াতরী (বিশেষ্য) নদী পারাপার করার নৌকা; ferryboat।
- খেয়াপার (বিশেষ্য) নৌকাযোগে নদীর এক পার থেকে অন্য পারে গমন।
- খেয়ামাঝি (বিশেষ্য) যে মাঝি খেয়ানৌকা চালায়।
- খেয়ারি, খেয়ারী (বিশেষ্য) যে মাঝি নদী পারাপার করে; ferryman।
Copyright @এস এম শাহনূর
smshahnoor82@gmail.com
(তথ্য সংগ্রাহক,লেখক ও গবেষক)