ঈশান নগর গ্রাম মেহারী ইউনিয়ন

ঈশান নগর গ্রাম মেহারী ইউনিয়ন

ষড় ঋতুর রঙশালা আমাদের এ বাংলাদেশ।ঋতু বৈচিত্রের এদেশে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে সজীবতা খুঁজে পায় সারা বছর শুকিয়ে থাকা খাল আর নদীগুলো।নতুন রূপে সেজে উঠে নদী তীরের জনপদ।অপরিকল্পিত গ্রামায়নের ফলে ক্রমশ ভরে যাচ্ছে এক সময়কার প্রবাহমান ছোট নদী আর খালগুলো।এর মধ্যেও বর্ষাকালে যে গায়ের যৌবন উপচে পড়ে তার নাম ঈশান নগর। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলার মেহারী ইউনিয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত এটি এমনই এক গ্রাম যার উত্তরে সেনের খাল আর দক্ষিণে রাজার খালের জলরাশির প্রবাহ খেলা করে।

★সীমানাঃ
উত্তরে-মেহারী।
পূর্বে-পুরকুইল।
দক্ষিণে-চৌবেপুর।
পশ্চিমে-রাজার খাল ও শিমরাইল গ্রাম।

★একনজরে ঈশান নগর গ্রাম-
*জনসংখ্যাঃ প্রায় ১০০০(হাজার)জন।
*নারী ও পুরুষের অনুপাতঃ ৪৯:৫১
*শিক্ষার হারঃ প্রায় ৭৫%
১ টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
১ টি আরবি শিক্ষার মক্তব।
১ টি মসজিদ।
১ টি কবরস্থান।
১ টি ঈদগাহ।
১ টি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন।মেহারী ইউনিয়নের ইউনিয়ন পরিষদ ভবনটি এ গ্রামেই অবস্থিত।

ছোট্ট একটি গ্রাম ঈশান নগর।আকারে ছোট হলেও অন্যান্য ক্ষেত্রে মোটেও ছোট নয়।খোঁজ নিয়ে জানা যায়,অত্র গ্রামের বহু শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন নামকরা মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছে।এছাড়াও এখানে অনেক গুণী শিক্ষক,সরকারী কর্মকর্তা,কৃতি ও বরেণ্য ব্যক্তিদের জন্ম হয়েছে।এঁদের মধ্যে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিম্নরূপঃ

★শিক্ষক ও শিক্ষানুরাগীঃ
*জনাব,আব্দুর রকিব(মাষ্টার)
(প্রাক্তন শিক্ষক,জমশেরপুর হাই স্কুল)।
তিনি কসবা উপজেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আলহাজ্ব নূরুল হকের(মাষ্টার)ও শিক্ষক ছিলেন।

*জনাব,মোঃ শফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া
সিনিয়র শিক্ষক,
কুমিল্লা ইউসুফ স্কুল।

*জনাব, মোঃ ইবাল হোসেন সরকার, বিএসসি
সিনিয়র শিক্ষক,
পুরকুইল মাদ্রাসা।

 

*প্রভাষক শামসুর নাহার মিতা
(মরহুম জনাব,নজ্জম সরকারের মেঝ ছেলের মেয়ে)।
ইংরেজি বিভাগ,
সরকারী বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ ডিগ্রী কলেজ।শর্শা,যশোর।

*প্রভাষক ফাতেমা হোসনে জাহান(রেখা)
(ঈশান নগর গ্রামের পুত্র বধূ,তিনি খেওড়া আনন্দময়ী উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক জনাব,আব্দুস সামাদ (স্যার)এর কন্যা ও শিক্ষাবিদ মরহুম আলহাজ্ব নূরুল হক(মাস্টার) এর নাতনী)।
অর্থনীতি বিভাগ,
সরকারী আদর্শ মহাবিদ্যালয়,
সৈয়দাবাদ,কসবা।

★বরেণ্য ব্যক্তিঃ
*জনাব,মরহুম শামসুল হক।
(বিশিষ্ট ব্যবসায়ী,সমাজ সেবক ও রাজনীতিবিদ)।

*জনাব,মরহুম আব্দুল মজিদ মেম্বার।
(শিক্ষানুরাগী ও সমাজ সংস্কারক)

★গুণীজনঃ
*জনাব,মরহুম নজ্জম সরকার,
*জনাব,গোলাম সরোয়ার সরকার,
*জনাব,চান মিয়া সরকার,
জনাব,আসমত আলী ভূঁইয়া,
জনাব,শামসু মিয়া প্রমুখ ব্যক্তিবর্গের নূরনগর ও বরদাখাত পরগনায় হা ডু-ডু খেলার জন্য সুখ্যাতি ছিল।

*মোহাম্মদ মানিক মিয়া(আয়কর আইনজীবী)
(বি,কম(সম্মান) এম কম;এল,এলবি)
গবেষণা লব্ধ প্রকাশনা –
(১) অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক সহায়িকা।
(২) অগ্নিঝুকি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা।
(৩) পোষাক শিল্প কারখানায় অগ্নিঝুকি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা।
এই শিরোনামে তিনটি প্রকাশনা রয়েছে।যাহা ইতোমধ্যে পোষাক শিল্পের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় সরকারী ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রকাশনা তিনটি ব্যাপক ভাবে সমাদৃত হয়েছে।তিনি বর্তমানে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি ইয়ংওয়ান,বাংলাদেশ এ ব্যবস্থাপক- সেফটি এর পাশাপাশি আইন পেশায় নিয়োজিত আছেন।

★সরকারী কর্মকর্তাঃ
*মেজর আব্দুল্লাহীল বাকী
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত।
(আব্দুর রকিব মাষ্টারের বড় ছেলে জনাব,আবু নাছার ওয়াহীদ দুলাল এর একমাত্র পুত্র)।

*জনাব,ইসমাইল মিয়া
এএসপি অব বাংলাদেশ পুলিশ।
(মরহুম আব্দুল মজিদ মেম্বারের ছেলে)।

*জনাব,মজিবুর রহমান টিটু
ইন্সপেক্টর অব বাংলাদেশ পুলিশ।
(মরহুম আব্দুল মজিদ মেম্বারের ছেলে)।

★সমাজসেবাঃ
গ্রামের বিভিন্ন জনহিতকর কাজে অনেক স্বদেশী ও প্রবাসীদের অবদান রয়েছে বলে জানা যায়।তাঁদের মধ্যে অন্যতম –
*জনাব,মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বাদল(আমেরিকা প্রবাসী)
*জনাব,খাদেমুল ইসলাম ভূঁইয়া (ইতালি প্রবাসী)
*জনাব,শামীম রেজা(ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ)
প্রমুখ।

আদিমযুগ থেকেই স্থান বা জাতির নামকরণের ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষ প্রাধান্য পায়। আধুনিক যুগেও এ প্রথা বিদ্যমান। যেমন গৌতম বুদ্ধের অনুসারীরা বৌদ্ধ, যীশুখ্রিস্টের অনুসারীরা ক্রিশ্চিয়ান বা খ্রিস্টান, কার্ল মার্কসের অনুসারীরা মার্কসবাদী প্রভৃতি। আবার শ্রীলঙ্কার আদম চূড়া কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি, ভারতের মম তাজমহল,হযরত শাহজালাল (রহ.) এর সফর সঙ্গী নাসিরউদ্দিনের নামানুসারে নাসিরনগর ইত্যাদি।
ঠিক তেমনি এক নাম ঈশান নগর।

 

★ঈশান নগর গ্রামের নামকরণের ইতিহাসঃ
পূর্ব বাংলা তথা ত্রিপুরা রাজ্যের জমিদারির ইতিহাস প্রমাণ করে এক সময় ব্রিটিশ শাসনামলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার কাইতলা জমিদার বাড়ি ছিল সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের মহারাজা বীর বিক্রম রাধা কিশোর মানিক্য বাহাদুরের অধিনস্থ নূরনগর পরগনার একটি পূর্ণাঙ্গ জমিদার বাড়ি।আর বিশ্বনাথ রায় চৌধুরী ছিলেন এ জমিদারি সাম্রাজ্যের প্রধানতম জমিদার।পরবর্তীতে তাঁর সুযোগ্য তিন পুত্র যথাক্রমে
(১)তিলক চন্দ্র রায় চৌধুরী,
(২)অভয় চন্দ্র রায় চৌধুরী,
(৩)ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরী
এবং প্রৌপুত্রগণ জমিদারি তদারকি ও পরিচালনা করেন।জানা যায়,পশ্চিম বঙ্গের শিমগাঁও নামক স্থান থেকে বিশ্বনাথ রায় চৌধুরী প্রথমে কাইতলা নামক জনপদে এসে বসতি স্থাপন করেন এবং জমিদারি লাভ করেন।প্রায় দুশো বছর আগে জমিদার ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরীর অধীনস্থ তালুকের উপর “একটি বাড়ি,একটি পুকুর” নিয়ে গড়ে উঠে আজকের ঈশান নগর নামক লোকালয়।

★নামকরণের পিছনের ইতিহাসঃ
প্রায় দুশো বছর আগে দৌলত নামক এক মুসলিম ব্যক্তি তার চার পুত্র সন্তান নাজাত,আজমত,রবিউল্লাহ ও অভিউল্লাহ সহ যমুনা গ্রামে বাস করতেন।তখনও যমুনা গ্রাম ছিল উগ্র হিন্দু সম্প্রদায়ের চরম আখড়া। শ্রী সয়ত্রী সেন নামক এক ব্যক্তির ত্রিপুরা রাজার দবারের সাথে ভাল সম্পর্ক ছিল এবং সেই সুবাদে বেশ যাওয়া আসাও ছিল।অভিজাত হিন্দু পরিবার খ্যাত সেনের বাড়ির চারপাশ দিয়ে কোন মুসলিম পরিবারের সন্তান জুতা পায়ে হেটে যাওয়া নিষেধ ছিল।কারণে অকারণে গরীব রায়তদের ধরে এনে অপমান অপদস্থ করত সেনের লোকজন। তখন যমুনা গ্রামের নাম লোকমুখে সেনের বাড়ি নামেই পরিচিত ছিল বলে জানা যায়।আর এই সেন পরিবারের সাথে জমির খাজনাদি ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধের কারণেই জনাব,দৌলত তার চার পুত্র সন্তান ও নিজ পরিবার সহ বর্তমান ঈশান নগর গ্রামে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেন।
কথিত আছে যে,কাইতলার জমিদার পুত্র ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরীর তালুক থেকে জনাব,দৌলত বসবাসের জন্য একখন্ড জমি চেয়ে নেন।সেই জমিতে এক রাতের মধ্যে (বর্তমান ঈশান নগর গ্রামে পুরাতন পুকুর নামে পরিচিত)একটি পুকুর খনন করে,পুকুর পাড়ে ভিটে বাড়ি তৈয়ার করে বসবাস শুরু করেন।আর সেই জমিদার পুত্র ঈশান চন্দ্র রায় চৌধুরীর দানের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন পূর্বক গ্রামের নামকরণ করেন ঈশান নগর।

★ঈশান শব্দের আভিধানিক ও ধর্মীয় অর্থঃ
ঈশান একটি বিশেষ্য পদ ও একটি জনপ্রিয় নাম।এই নামের উল্লেখ শিব পুরাণে আছে, এবং এটি বিষ্ণুর নামও হয়।

★ব্যুৎপত্তিঃ[সং. √ ঈশ্ + আন]।

#ইসলাম_ধর্মে,ঈশান মুসলিমদের মধ্যেও এক জনপ্রিয় নাম।অর্থ হ’ল– “ঈশ্বরের আশীর্বাদ” বা “যোগ্য”।

#হিন্দু_ধর্মে,ঈশান হিন্দু ভগবান শিবের এক নাম।শিব হিন্দু ত্রিমূর্তি (ব্রহ্মা , বিষ্ণু, শিব)এর অন্যতম। এর মূল “ঈশ [ব্যুৎপত্তিঃ [সং. √ ঈশ্ + অ]] যার অর্থ(প্রভু,ভগবান,স্বামী,প্রাণেশ,মহেশ)জগতকে শাসন করা অদৃশ্য শক্তি। ঈশান ও ঈশ্বর একার্থক।
ঈশান শব্দের অর্থ ‘ শিব, মহাদেব;এবং ‘ উত্তর-পূর্ব’ দিকও হয়। বাস্তু শাস্ত্রের মতে
ঈশান্য দিকের অর্থ সমৃদ্ধি, ঐশ্বর্য্য ও জ্ঞান। হিন্দু ধর্মে উত্তর দিকে সুখ এবং পূর্ব দিকে জ্ঞান বোঝায়। ঈশান দুই-য়েরই মিলন।
শিবের পাঁচটা রূপ আছে। প্রতিটি রূপে
পঞ্চতত্ত্ব– অগ্নি, জল, বায়ু , পৃথিবী ,
আকাশ , এক একটিকে বোঝায়। ঈশান — শিবের পঞ্চম রূপ, যা উপর দিকে চেয়ে থাকে এবং পঞ্চতত্ত্বের ‘আকাশ’ বোঝায়।

#বৌদ্ধ_ধর্মে,জাপানী বৌদ্ধ বিশ্বাস অনুযায়ী,ঈশান বা ঈশানাটেন [টেন’ (天) যা ‘দেব’-এর সাথে সমার্থক।] উত্তর-পূর্ব দিকের রক্ষক।

★তথ্যসূত্রঃ
[১] কাইতলা জমিদার বাড়ির ইতিহাস
নব সাহিত্যের পাতা সাময়িকী
প্রকাশকালঃ১৯৯৮ ইংরেজি।
[২] মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা।

[৩] নামকরণের ইতিকথা।। এস এম শাহনূর

 

👍Copyright @এস এম শাহনূর
smshahnoor82@gmail.com
(তথ্য সংগ্রাহক,লেখক ও গবেষক)