বাহারআটা গ্রাম মেহারী ইউনিয়ন

বাহারআটা গ্রাম মেহারী ইউনিয়ন

কসবার বাহারআটা গ্রামের নামকরণের ইতিকথা: এস এম শাহনূর
 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার কসবা উপজেলাধীন ২নং মেহারী ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের অন্তর্ভুক্ত ছোট্র একটি গ্রাম বাহারআটা।উত্তর দক্ষিণে প্রায় আধা মাইল লম্বালম্বি অত্র গ্রামের জনসংখ্যা ৮০০ জনের অধিক নয়।লোকমুখে শোনা যায় মোঃ সরব আলী ওরফে পচু গাজী নামক এক ব্যক্তি সপরিবারে দক্ষিণের কোন এক জনপদ থেকে এখানে এসে প্রথম বসতি স্থাপন করেন।বংশগতির ধারাবাহিকতায় পচু গাজীর পরবর্তী প্রজন্ম আজও পচু গাজীর গোষ্ঠী নামে পরিচিত। অত্র গ্রামের কৃতি সন্তান মরহুম ডাঃআব্দুর রাজ্জাক; চিকিৎসা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য কসবা উপজেলার এক কিংবদন্তী ব্যক্তি।জোনাকিপোকার মৃদু আলো ছাড়া যে গ্রামের লোকজন নিকষকালো রাতের পথ দেখতেন না,সেই বাহারআটা গ্রামে যিনি ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ বাহার ছড়িয়েছেন তিনি হলেন সাবেক বিদ্যুৎ সচিব মোঃ জামসেদ চৌধুরী।
মুক্তিযোদ্ধা এ.কে. ফজলুল হক: যিনি বাহারআটা ও পুকুরপাড় গ্রামের ঈদগাহ স্হাপনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।

♦এছাড়া আরো বহু জ্ঞানী,গুণী মানুষজন তাঁদের কর্মের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত গ্রামের সুনাম বয়ে আনছেন।তাঁদের মধ্যে


★আঃ হান্নান রনি(এ.এস.পি) :যিনি মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল ইসলাম(দারোগা)-এর ছেলে।
★ডাঃরুনা আহমেদ:
(সার্জেন্ট অলী আহমেদ এর সহধর্মিনী ও বড় বাড়ির পুত্র বধূ)
★মোঃ রুহুল আমীন-এম.ডি.
বাংলাদেশ থাই এলুমিনিয়াম লিঃ।
★ডাঃ আহসান হাবিব (এম.বি.বি.এস)
★আবু কাউসার: (রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও শিক্ষানুরাগী)
★রাজনীতিবিদ আঃ রশীদ: যিনি বাহারআটা ও পুকুরপাড় গ্রামে সর্ব প্রথম আওয়ামীলীগের বীজ বপন করেন
★এডভোকেট খোরশেদ আলম (পারভেজ)। এপিপি; জজ কোর্ট,ঢাকা।
★নাজমুল হাসান:
সিনিয়র অফিসার,বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
★এডভোকেট আয়নাল হক বাবু
★প্রভাষক মাসুদ রানা: আহবায়ক সদস্য,কসবা উপজেলা আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও সাধারন সম্পাদক, স্বাধীনতা মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদ কসবা উপজেলা শাখা।বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য।

♦পুকুরপাড়ঃ লেশিয়ারা গ্রামের রঞ্জিত কর নামক এক ধনাঢ্য হিন্দু ব্যবসায়ী বাহারআটা গ্রামে একটি গভীর ও বিশাল পুকুর খনন করেন।সুপেয় মিঠা পানি আর নানাবিধ সুবিধার কারণে আস্তে আস্তে পুকুরের চারপাশে জনবসতি ও ঘনবসতি গড়ে উঠে।বর্তমানে পুকুরের চারপাশে বসবাস করা লোকজন নিজেদেরকে পুকুরপাড়ের অধিবাসী বলে পরিচয় দিয়ে থাকেন।

♦নানান মত আর পেশার ৩টি গোষ্ঠী বা বংশীয় মানুষের এক অপূর্ব মেলবন্ধন আজকের বাহারআটা গ্রাম।গোষ্ঠী গুলোর নামঃ
১।পচু গাজীর গোষ্ঠী
২।ইডা গাজীর গোষ্ঠী ও
৩।বড় বাড়ী (গ্রামের বড় বড় ঘর ছিল যেখানে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ এখানে এসে বাস করত।)ও

♦এ ছাড়া এখানে রয়েছে
১টি মসজিদ।
১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।
১টি মসজিদ ভিত্তিক গণশিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
১টি কবরস্থান।
১টি ঈদগাহ।
১টি ক্লাব: ড. বাড়ী ফাউন্ডেশন(প্রস্তাবিত)।

 

সীমানাঃ
উত্তরে-পুরকুইল গ্রাম।
দক্ষিণে-বুগীর,বামুটিয়া গ্রাম।
পশ্চিমে-ঈশান নগর গ্রাম।এবং
পূর্বে-খেওড়া গ্রাম।

বাহারআটা গ্রামের নামকরণঃ
নাম দিয়ে কী হয়, নামের মাঝে পাবে তুমি আসল পরিচয়।’ নামকরণ বা নাম রাখা নিয়ে এ দেশে বহু ঘটনা আছে। এ সব ঘটনা নিয়ে রটনাও আছে। তবে এ কথা ঠিক হাজার বছর ধরে বাঙালি এই কাজে বেশ পারঙ্গম। এর প্রমাণ সর্বত্র। যেমন নদ-নদীর নাম। গ্রাম-জনপদের নাম। ফুল-পাখীর নাম ইত্যাদি।
গবেষণা ও বিভিন্ন তথ্যাদি থেকে জানা যায়,কোন এক সময় এখানে বড় বড় বৃক্ষাদির সমাহার ছিল। স্থানীয় ভাষায় লোকজন গাছগাছালি পরিপূর্ণ এমন এলাকাকে আড়া(জঙ্গল)বলত।অবশ্য শুধু এখানটা ছাড়া তখনও অনতিদূরে লোকালয় গড়ে উঠেছিল।আর এটি বেশী দিনের কথা নয়।ধারনা করা হয় ১৫০ বছর পূর্বে এখাানে প্রথম জনবসতি গড়ে উঠে।

পাশেই ছিল যৌবনা রাজার খালের প্রবাহ।যা প্রতিদিনই জোয়ার ভাটার ডাকে সাড়া দিত।জেলেরা জাল ফেলে মাছ ধরত।নাওয়ের মাস্তুলে পাল উড়িয়ে গলা ছেড়ে জারি সারি গান গাইত মাঝি মাল্লার দল।তবে কালের প্রবাহের সাথে রাজার খালের প্রবাহ আজ মৃতপ্রায়।এখানে ছিল উত্তরাঞ্চলের মানুষজনদের জন্য কুটি বাজার তথা কুমিল্লা যাওয়া আসা করার একমাত্র পায়ে হাটার রাস্তা।এ গেয়ো রাস্তা ধরে চলার পথে ক্লান্ত পথিক যেখানে এসে থমকে যেত,মাথার ভারী বোঝা কিংবা কাঁধের ভার রেখে কৃষক বা গ্রাম্য ব্যবসায়ীরা যেখানে এসে গাছের সৌন্দর্যময় সুশীতল ছায়ায় একটু বিশ্রাম নিত;বসত বেচাকেনার হাট সেই স্থানটিই আজকের বাহার হাটা>বাহার আটা গ্রাম।

”বাহার” শব্দটা ফারসী ‘বহার’ শব্দজ অর্থাৎ ‘বহা’ শব্দের অপভ্রংশে “বাহার” ;

ফারসী শব্দ বাহার মানে বসন্ত। যা বাংলায় এসে অর্থ দাড়িয়েছে শোভা,সৌন্দর্য,মনোহারিতা,চটক।
“পথ পথিকের সৃষ্টি করেনা,পথিকই পথের সৃষ্টি করে”।আজ প্রায় দেড় শত বছর পরে ইতিহাস জানলো পথিক শুধু পথধরে হাটেই না,হাটতে হাটতে যে পথের মাঝে পথিক বসন্ত বাহার, শোভা,সৌন্দর্য আর মনোহারিতা খুঁজে পায়, তাদেরই কোন এক নাম না জানা পথিক এ স্থানের নাম দেন বাহারহাটা।
ইতিহাস থেকে জানা যায় বেশীর ভাগ মানব সভ্যতা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে।এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বাহারহাটার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর স্রোতম্বিনী রাজার খালের সুবিধাদি ভোগ করার জন্য আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে লোকজন এখানে এসে এক নতুন জনপদ গড়ে তোলেন।পরবর্তীতে গ্রামের সুধীজন বাহার হাটা নামকে কিঞ্চিত পরিবর্তন করে নাম রাখেন বাহারআটা।তবে পুরাতন দলিল দস্তাঁবেজে আজও বাহারহাটা ই আছে।

অন্য এক তথ্যমতে,বিশেষতঃখেওড়া ও পুরকুইলের মত প্রাচীন গ্রামগুলোর প্রবীণ ব্যক্তিরা মনে করেন,উনাদের গ্রামের(দক্ষিণে)বাহিরে বিভিন্ন গ্রাম থেকে কয়েকটি পরিবার এসে নতুন করে বসবাস শুরু করলে গ্রামের লোকজন তাদের সেই পাড়াকে গ্রাম্য কথ্য ভাষায় বাহির (হাটা)আটি/আডি (পাড়া)বলত।এবং সেই পাড়ায় বসবাসকারী লোকজনও নিজেদেরকে বাহির আটির(পাড়ার)লোক বলে পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত।এভাবে কালক্রমে বাহির আটি থেকে গ্রামের নামকরণ হয়ে যায় বাহারআটা।

প্রয়োজনীয় নোটঃ

★বাহির /বিশেষ্য পদ /
১. বর্হিভাগ,
২. ভিতরের বিপরীত দিক;
৩. গৃহের সদর বা বাইরের অংশদ গুহ হতে অন্যত্র;
৪. ঘরের বাইরের জীবন ও জগত (বাহিরের আলো, বাহিরের জীবন);
৫. বাইরের দিক, বহির্দেশ (বাড়ির বাহিরটাই দেখেছি)।

বাহার /বিশেষ্য পদ/
ফারসি শব্দ ;
শোভা,
সৌন্দর্য;
মনোহারিতা;
সঙ্গীতের রাগিণীবিশেষ।

 

উত্তর ভারতীয় সঙ্গীত
পদ্ধতিতে কাফি ঠাটের অন্তর্গত রাগ বিশেষ।[১]

হাটাঃ হাটা সংস্কৃত হট্ট শব্দ হতে উদ্ভূত। বাংলাদেশে হাটা প্রত্যয় যোগে বেশ কিছু গ্রামের নাম রয়েছে।
যেমন,
দিনহাটা , দেবহাটা , দুর্গাহাটা, মাঝিহাটা, ময়দানহাটা।

আঁটি , আটি [আঁটি, আটি (আঞ্চলিক)] (বিশেষ্য)
তৃণ বা শস্যাদির গুচ্ছ
(আঁটি আঁটি ধান চলে ভারে ভার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর); (আলঙ্কারিক)

পূব আটির ছেলে মেয়েরা পচিম আটির মক্তবে ফরতে আসে।(সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক ভাষায় পাড়া অর্থে।)[২]

স্বার্থপরতা (নিজের বেলায় আঁট আঁটি, পরের বেলায় চিমটি কাটি-নিজে আঁটি বেঁধে নেয়, পরকে দেওয়ার সময় এক চিমটিতে যতটুকু (যৎসামান্য) ওঠে, দেয়)।

বোঝার উপর শাকের আটি খুব ভারী জিনিসের উপর সামান্য বস্তুর ভার।

আঁটি , আঁঠি, আটি , আঠি [আঁটি, আঁঠি, আটি, আঠি]
(বিশেষ্য) ফলের মধ্যস্থ বড়ো বীজ বা বিচি (আম আঁটির ভেঁপু-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়; ন্যাংড়া আমের আঁঠি-প্রথম চৌধুরী)।

আঁটিসার (ক্রিয়াবিশেষণ) আঁটি মাত্র অবশিষ্ট রেখে; নিঃশেষে (চুষিয়া আঁটিসার করিয়া খাইবার ক্ষমতা রাখে-বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)।

(বিশেষণ) আঁটিসর্বস্ব; বড়ো আঁটিযুক্ত (আঁঠিসার আম খেয়ে আশ মেটে না)।

তথ্যসূত্র:
[১] রাগ বিন্যাস (প্রথম কলি)। শ্রীশচীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য। এস, চন্দ্র এন্ড কোং। শারদীয়া সপ্তমী, সেপ্টেম্বর ১৯৭৬।

[২] ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক
অভিধান।
[৩] শরীফ এ কে এম শামসুল হক
সাবেক চেয়ারম্যান,
মেহারী ইউনিয়ন পরিষদ।
[৪] প্রভাষক মাসুদ রানা
সাধারন সম্পাদক,
স্বাধীনতা মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদ
কসবা উপজেলা শাখা।
[৫] মাঠ পর্যায়ে ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা।

Copyright@এস এম শাহনূূর
smshahnoor82@gmail.com
(তথ্য সংগ্রাহক,লেখক ও গবেষক)