একনজরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা

একনজরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা

 নামকরণ ও প্রতিষ্ঠা 

বিভিন্ন গ্রন্থে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের ভিন্ন ভিন্ন তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের গুরুত্বপূর্ণ একটি মত হচ্ছে, আদিতে ত্রিপুরার রাজাদের সহায়তায় ও আনুকূল্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বহু সংখ্যক ‘ব্রাহ্মণ’ বসবাস করত। এই রাহ্মণদের বাসস্থানরূপে ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উদ্ভব হয়েছে বলে মত রয়েছে। প্রাচীন নথিপত্রে ২৭৪ নং জেএল দাগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরাঞ্চলের একটি অংশ ব্রাহ্মণবাড়িয়া মৌজা নামে অভিহিত।

ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলাদেশ তথা এ অঞ্চল মুসলমানদের আগমনের আগে সেনদের শাসনাধীনে ছিল। সেনদের আদিনিবাস ভারতের কর্ণাটক। এরা ছিল ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের।পরবর্তীকালে অবশ্য ক্ষত্রিয় হয়। লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে এ অঞ্চলে কোনাে ব্রাহ্মণ পরিবারের বসবাস ছিল না। ফলে বছরের বিভিন্ন সময়ে পূজা-পার্বণে | হিন্দুদের বিশেষ অসুবিধার সম্মুখীন হতে হতাে। এ অসুবিধা দূরীকরণের জন্য রাজা লক্ষণ সেন তাঁর শাসনাধীন কান্যকুজ থেকে কয়েকটি ব্রাহ্মণ পরিবার এখানে এনেছিলেন। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ শাসনামলে কিংবা তারও কিছুকাল আগে সরাইলের প্রভাবশালী জমিদার দেওয়ান মুস্তফা আলী আরও কিছু ব্রাহ্মণ নিয়ে আসেন।ধারণা করা হয়, আগত ব্রাহ্মণদের বাড়ি বা আস্তানা থেকে এই জনপদের নামকরণ হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

আবার অনেকে মনে করেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের সঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে অবস্থিত হযরত কাজী মাহমুদ শাহ্ (র.) এর নাম জড়িত। তিনি ষােড়শ কিংবা সপ্তদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে বসতি স্থাপন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কেন্দ্রস্থল কাজীপাড়ায় তাঁর মাজার রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ‘ব্রাহ্মণরা’ কাজী সৈয়দ মাহমুদ শাহ্ (র.) এর অলৌকিক ক্ষমতায় বিস্মিত হন। পরবর্তীকালে কাজী মাহমুদ শাহ্ (র.) এর প্রতি সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় নবীনগর উপজেলার বিদ্যাকুটে চলে যায়। কাজী মাহমুদ শাহ্ (র.) তখন ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। এভাবে ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাওয়ার বিষয় অবলম্বনে আজকের ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া’ নামকরণ হয়েছে বলে কারাে কারাে ধারণা। এ মতবাদের ঐতিহাসিক কোনাে ভিত্তি নেই। এ মতবাদটি মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে এসে অনেকটা কিংবদন্তি হিসেবে বিভিন্ন বই-পুস্তকে স্থান করে নিয়েছে।

বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কমিল্লা জেলার অন্তর্গত মহকুমা ছিল। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছিল বৃহত্তর ত্রিপুরা জেলার অন্তর্ভুক্ত। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা গঠিত হয়েছিল। ১৯৬০ সালের ১ অক্টোবর থেকে ত্রিপুরা জেলার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও চাঁদপুর মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা । পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সনের ১৫ ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামে মেঘনা ও তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাস এবং ঐতিহ্য রয়েছে। বর্তমানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অন্তর্গত ৯টি থানা বা উপজেলা, ৫ টি পৌরসভ, ১০০ টি ইউনিয়ন এবং প্রায় ১৩৩১ টি গ্রাম রয়েছে। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী জেলার লােকসংখ্যা ২৮ লাখ ৪০ হাজার ৪৯৮ জন (২০১২ সালের ১৬জুলাই প্রকাশিত তথ্য)। ২০০১ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী জেলার লােকসংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৯৮ হাজার ২৫৪ জন। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লােকসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ লাখ।

জেলার অবস্থান এবং জলবায়ু

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উত্তরে হবিগঞ্জ ও কিশােরগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে মেঘনা নদী, কিশােরগঞ্জ, নরসিংদী ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে কুমিল্লা জেলা ব্রাহ্মণপাড়া ও মুরাদনগর পূর্বে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য এবং উত্তর-পূর্ব কোণে হবিগঞ্জের মাধবপুর । জেলার মােট আয়তন ১৯২৭.৩০ বর্গ কিলােমিটার। মােট ৯টি উপজেলা নিয়ে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা গঠিত। উপজেলাগুলাে হলাে- ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আখাউড়া, কসবা, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর, নাসিরনগর, সরাইল, আশুগঞ্জ ও বিজয়নগর ।

ভৌগােলিক অবস্থানের দিক থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। এ জেলা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা পৃথিবীর পূর্ব গােলার্ধের প্রায় মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। এর পূর্ব-দ্রাঘিমাংশ ৯০°-৩৯ থেকে ৯১°-২১ এবং উত্তর-অক্ষাংশ ২৩°-৩৯ থেকে ২৪°-১৬। বলা যায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবস্থান পৃথিবীর পূর্ব-গােলার্ধের ঠিক মধ্যে অবস্থিত। কর্কটক্রান্তি রেখা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। তাই এ জেলা পুরােপুরি ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। এ জন্যে স্বাভাবিকভাবেই এ অঞ্চলে ক্রান্তীয় মৌসুমে জলবায়ু পরিলক্ষিত হয়। বর্ষাকালে এ জেলায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। এখানকার বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত ৮০-১২০। শীত ও গ্রীষ্মকালে জেলার তাপমাত্রা যথারীতি কম-বেশি পরিলক্ষিত হয়। গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে এ জেলার তাপমাত্রা ৩২° থেকে ৩৮° সেলসিয়াস পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। তবে জেলার গড় তাপমাত্রা প্রায় ৩০° সেলসিয়াস। তাপমাত্রার আলােকে বলা যায়, এ জেলার জলবায়ু আরামদায়ক এবং স্বাস্থ্যপ্রদ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। জেলার পূর্বাঞ্চলে এক ফালি সংকীর্ণ উঁচু ভূমি থাকলেও বেশির ভাগ ভূমিই উচু-সমতল ও নিম্ন সমতল এবং অবশিষ্টাংশ বিল-হাওড়ে আকীর্ণ। এক কথায় উত্তর-পূর্ব দিক থেকে জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম দিক মােটামুটি ঢালু বলা চলে ।

চাষাবাদের জন্য মােটামুটিভাবে উপযােগিতার ক্ষেত্রে সমগ্র জেলার পঁচাত্তর শতাংশ জমি মাঝারি থেকে ভালাে মানের এবং পঁচিশ শতাংশ কিছুটা নিম্নমানের (চাষাবাদ উপযােগী মােট জমির হিসেব)। অঞ্চলভেদে এটেল, বেলে ও দোআশ এই সবধরনের মাটিরই সাক্ষাৎ পাওয়া যায় এ জেলায়। তবে দোআশ মাটিই অধিকাংশ। এলাকায় রয়েছে। বর্ষার বন্যায় সমতল ও নিচু জমিতে পলি পড়ে জমি উর্বর হয় । ফসল ফলানাের জন্য তা আশীর্বাদস্বরূপ। জেলার কোনাে কোনাে এলাকা এত নিচ যে সারা বছরই জলমগ্ন থাকে। অন্যদিকে জেলার অন্যান্য অংশ বর্ষাকালে পাঁচ থেকে দশ ফুট বা তারও বেশি জলের নিচে তলিয়ে যায়। আবার তিতাস ও বুড়িগাঙ্গের মিলনস্থল। এবং বিভিন্ন নিচু এলাকার উপর ২০ থেকে ৩০ ফুট পানি জমা হয়। কিন্তু শীতকালে তা শুকিয়ে যায়।

বনভূমি ও গাছপালা

ঐতিহ্যবাহী ব্রাহ্মণবাড়িয়া একটি প্রাচীন জনপদ। প্রাচীনকাল থেকেই এখানে বনভূমি ও গাছপালা বিকশিত হয়েছে। তবে এখানে গাছগাছালির তুলনায় বনভূমি অপেক্ষাকৃত কম এমনকি নেই বললেও চলে।ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় সমগ্র এলাকাকে বন্যা-প্লাবিত সমতল ভূমি হিসেবে ধরা যায়। প্রায় সমতল অঞ্চল থেকে সামান্য উঁচু-নিচু, চড়াই-উত্রাই এর প্রকৃতি। মেঘনা, বিজনা, বুড়ি ও তিতাস বিধৌত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা মৌসুমি বন্যায় প্লাবিত হয়। জেলার পূর্বদিকের শেষ প্রান্তে কসবা-আখাউড়া ও বিজয়নগর উপজেলায় কিছু পাহাড়ি এলাকা ও বনভূমি দেখা যায়। এ ছাড়া সমগ্র জেলার মাটি সম্প্রতি এবং সাম্প্রতিক নদীবাহিত পলি দ্বারা গঠিত। এসব এলাকার মাটির গঠনপ্রকৃতির মধ্যে পলি থেকে কাদা এবং জৈব পদার্থের পরিমাণ মাঝারি অথবা কম পরিলক্ষিত হয়। একটি এলাকার বনভূমি এবং গাছপালা যেহেতু মাটির উপর নির্ভরশীল সেহেতু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বনভূমি ও গাছপালা নিয়ে আলােচনার ক্ষেত্রে এখানকার মাটির প্রকৃতি নিয়ে আলােকপাত করা প্রয়ােজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় ৮ প্রকারের মাটি দেখা যায় । যেমন :

মধ্য মেঘনা প্লাবন সমভূমি : প্রায় ১০৪ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এ ধরনের মাটি রয়েছে। ঢেউ খেলানাে দীর্ঘ উঁচুভূমি, মাঝারি উঁচুভূমি ও বিল এর আওতাভুক্ত। প্রায় ১৬ বর্গমাইল এলাকা হালকাভাবে প্রাবিত, ৩১ বর্গমাইল মাঝারি থেকে গভীরভাবে। প্লাবিত, ২৬ বর্গমাইল গভীরভাবে প্লাবিত এবং ১৪ বর্গমাইল এলাকা অত্যন্ত গভীরভাবে প্লবিত হয়ে থাকে। প্রায় ১৭ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে রয়েছে ঘরবাড়ি। পানি নিষ্কাশ ব্যবস্থা দুর্বল। মাটির রং ধূসর থেকে জলপাই ধূসর। অতি সাম্প্রতিককালে যেসব হা” পলি পড়েছে, যেসব স্থান প্রায়ই খালি অথবা বিক্ষিপ্ত ছােট ছােট ঘাসে আচ্ছ। অবশিষ্ট এলাকায় চাষাবাদ হয়। চাষিরা প্রধানত বােনা আমনের পর, রাবিশস্য এবং আউশের পর রােপা আমন ও রবিশস্য করে থাকে। রবিশস্যের ভেতর সরিষা, মরিচ গােল আলু, চিনা, কাউন, গম, ডাল ও শাকসবজি উল্লেখযােগ্য।

পুরাতন মেঘনা মােহনা প্লাবন সমভূমি : প্রায় সমতল ৩৯৩ বর্গমাইল ভূ-ভাগ নিয়ে এই এলাকা গঠিত। জমি তৈরি করে তার উপর ঘরবাড়ি গড়ে তােলা হয়েছে। চড়াইউত্রাই এর পার্থক্য খুবই কম কারণ বেশির ভাগ ভূমিই সমতল । প্লাবনতার নিরিখে প্রায় ৮৮ বর্গমাইল এলাকা হালকাভাবে প্লাবিত, ১৭৫ বর্গমাইল এলাকা মাঝারি থেকে গভীরভাবে প্রাবিত, ৩১ বর্গমাইল এবং ৪৪ বর্গমাইল এলাকা অত্যন্ত গভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। ঘরবাড়ির আওতাধীন এলাকা প্রায় ৫৫ বর্গমাইল । উঁচু এলাকার মাটিতে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালাে নয়। মাটির রং গাঢ় ধূসর থেকে হলদে বাদামি । উপযুক্ত এলাকার শস্য পর্যায়গুলাে নিম্নরূপ :

  • ক. বােনা আমনের পর রবিশস্য।
  • খ. মিশ্র আউশ ও বােনা আমনের পর রবিশস্য।
  • গ. আউশের পর রােপা আমন।

কখনও কখনও রােপা আমনের পর রবিশস্য আবাদ করা হয়ে থাকে। সালদা প্লাবন সমভূমি : সালদা নদী সংলগ্ন মাত্র তিন বর্গমাইল এলাকা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। এই এলাকা বছরে দু’বার প্লাবিত হয়ে থাকে। ত্রিপুরা পাহাড় থেকে তুল নামার সময় একবার এবং মেঘনা নদী স্ফীত হয়ে ওঠার সময় আরেকবার এভাবে প্রায় তিন চতুর্থাংশ এলাকা গভীরভাবে প্লাবিত হয়। নিচু এলাকাগুলাে মেঘনা পলি দিয়ে গঠিত। মাটি সূক্ষ্ম কণাবিশিষ্ট ও রং অত্যন্ত গাঢ় ধূসর বর্ণের।

সুরমা-কুশিয়ারা প্লাবন সমভূমি : ছােটবড়াে নালা ও কিছু উঁচু এলাকা নিয়ে তুলনামূলকভাবে নিচু এই অঞ্চল গড়ে উঠেছে প্রায় ১৯ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে। এর শতকরা ৪০ ভাগ অত্যন্ত গভীরভাবে প্লাবিত ৩০ ভাগ এলাকার জমি কিছুটা উঁচু এবং মাঝারি থেকে গভীরভাবে প্লাবিত। শুষ্ক মৌসুমের প্রথম দিকে অপেক্ষাকৃত এলাকাগুলাে শুকনাে থাকে এবং নিচু এলাকা ভেজা থাকে।

তিতাস প্লাবন সমভূমি : এই এলাকাসমূহ অত্যন্ত গভীর। আয়তন মােট ৮৮ বর্গমাইল । শতকরা ৭২ ভাগ এলাকা অত্যন্ত গভীরভাবে এবং ১১ ভাগ গভীরভাবে প্লাবিত । শুষ্ক মৌসুমের বেশির ভাগ সময়ই ভেজা থাকে। মাটির রং কালাে থেকে ধূসর এবং কাদাময় । বােরাে ধান একমাত্র ফসল । অধিকাংশ এলাকাই তৃণাচ্ছাদিত থাকে।

পিডমিন্ট পাললিক সমভূমি : এটি একটি জটিল এলাকা। এখানে রয়েছে ৫৪ বর্গমাইল বিস্তৃত উপত্যকা, উঁচুভূমি, সমভূমি ও নিচু এলাকা। এলাকার শতকরা ২০ ভাগ মধ্যম-উচ্চভূমি, মধ্যম-নিম্নভূমি এবং নিম্নভূমি । শতকরা ১৭ ভাগ উচ্চভূমি এবং শতকরা ১২ ভাগ অতি নিম্নভূমি। মাটির রং ধূসর। নিচু এলাকার মাটি মােটামুটি অশ্ল থেকে কিছুটা ক্ষারযুক্ত। হাল্কা প্লাবিত এলাকায় আউশের পর রােপা আমন চাষ করা  হয় । মধ্যম নিম্নভূমি ও নিম্নভূমি অঞ্চলে বোনা আমনের সঙ্গে আংশিক আউশ মিশিয়ে ধানের চাষ হয়। ছােট খালের পাশের জমিতে যেখানে সেচের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে এক ফসলি বােরাে জন্মে। এই এলাকার জন্য পাট চাষ গুরুত্বপূর্ণ নয়।

আখাউড়া উচ্চ সমভূমি : ২৯ বর্গমাইল উপত্যকা নিয়ে এই অঞ্চল গঠিত। শতকরা ১৬ ভাগ এলাকা হালকা থেকে গভীরভাবে প্লাবিত হয়ে থাকে। বাকি এক স্বাভাবিক বন্যা সীমার উর্ধ্বে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা মােটামুটি ভালাে । মাটি কাদা এবং রং হলদে বাদামি থেকে হলদে-লাল অথবা লাল । এই এলাকায় আউশের পর রবিশস্য আবাদ করা হয়। ফলের বাগানও করা যায়। এ ছাড়া নিচু এলাকায় প্রচুর ঘাস জন্মে থাকে। উপত্যকাগুলােতে আউশ ও রােপা আমন দুই ফসল হয়।

পাহাড়িয়া মাটি : ৬ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে এই এলাকা গঠিত। পানি নিষ্কাশনের খুব ভালাে ব্যবস্থা রয়েছে। উপরের মাটি সামান্য গাঢ় লাল রঙয়ের এবং নিচের মাটি বাদামি থেকে হলদে লাল। কোনাে কোনাে মাটিতে উদ্ভিদের জীবাশ্ম দেখা যায় । পাহাড় এবং উপত্যকা পাদদেশের মাটি প্রায়ই কড়া অম্লময়। পূর্বদিকের পাহাড়গুলাে ঘাস এবং ঝোপঝাড়ে আচ্ছাদিত।

জলবায়ু : কর্কটক্রান্তি রেখা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার উপর দিয়ে অতিক্রম করেছে। তাই এ জেলা পুরােপুরি ক্রান্তীয় অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। সেই জন্য স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলে ক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু পরিলক্ষিত হয়। এ জেলায় বর্ষাকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় এবং শীতকালে বৃষ্টিপাত হয় না বললেই চলে। এখানকার বাৎসরিক বৃষ্টিপাত ৮০-১২০। জেলার তাপমাত্রা শীত ও গ্রীষ্মকালে যথারীতি কম-বেশি পরিলক্ষিত হয়। এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা ৩২° সে. থেকে ৩৮° সে পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। তবে জেলার গড় তাপমাত্রা ৩০°সে.। তাপমাত্রার আলােকে বলা যায় এই জেলার জলবায়ু আরামদায়ক ও স্বাস্থ্যকর।।

উদ্ভিদ ও কৃষিজাত শস্য ও গুল্মলতা : একশ বছর আগে ত্রিপুরা রাজ্যে বনাঞ্চল থাকলেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় বর্তমানে বনাঞ্চল নেই বললেও চলে। এখানে বনাঞ্চল থাকলেও মৌসুমী জলবায়ু পলি মিশ্রিত উর্বর মৃত্তিকার কারণে এ জেলায় উদ্ভিদের প্রাচুর্য লক্ষ করা যায় । যে সব উদ্ভিদ এখানে খুব বেশি দেখা যায় সেগুলাের মধ্যে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল, তেতুল, বট, অশ্বথ, নিম, রয়না বা পিতরাজ, শিমূল, তুলা, মান্দার, মান্দাইল, খেজুর, তাল, সুপারি, কদম, শেওড়া, হিজল, কুল, ডুমুর, বাতাবি নেবু (জাম্বুরা), জলপাই, বিলেম্বু, কামরাঙা, পেয়ারা, জামরুল, আমড়া, লিচু, ইউক্লিপটাস, ঝাউ, শাল, শিশু, কড়ই, মেহগনি, রেইনট্রি প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

কৃষিজাত শস্য জেলার অধিবাসীদের প্রধান অর্থনৈতিক উৎস। কৃষিজাত শস্যের মধ্যে ধান, পাট ও সরিষাই উল্লেখযােগ্য। এ ছাড়া মসুরি, কলাই, খেসারি, মুগ, মটর, ছােলা, বাদাম, কাওন (দোন্দা), আলু, ধনে, তিল, মরিচ, তরমুজ, ক্ষীরা, বাস, পেয়াজ, রসুন ইত্যাদি রবিশস্যের ফলনও ভালাে হয়। এগুলাে ছাড়াও শীতকালে শাকসবজি যেমন টমেটো, ফুলকপি, ওলকপি, বাধাকপি, লেটুস, শালগম, পালংশ ইত্যাদি প্রচুর চাষ হয়। দেশি শাকসবজি যেমন মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, সিম, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা (কইডা), বেগুন, বরবটি, ডাটা, লালশাক, ঢেড়স, কচু ইত্যাদি বেশ ফলন হয়। পটল এ জেলায় চাষ না করলেও কাকরােল এর চাষ জেলার পূর্বাঞ্চলে ব্যাপকভাবে করা হয়। জেলার গুল্মলতার মধ্যে ফণিমনসা, থানকুনি, দুর্বা, বাসক, গন্দভাদালি, ধুতরা, কেওয়া, হেলেঞ্চা, সাইচা, কলমি, পুদিনা, শালুক, ঘেচু, শাপলা ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। এ সকল গুল্মলতার কোনাে কোনােটি বনৌষধি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়।

পশু-পাখি : বনাঞ্চল নেই বলে বন্যপশুর অস্তিত্ব তেমন নেই। পূর্বে ত্রিপুরারাজ্য সীমান্তের বনাঞ্চলে হরিণ, বাঘ, চিতাবাঘ, বনবিড়াল, প্রভৃতির অস্তিত্ব ছিল। এখন এসব প্রাণী এই অঞ্চলে বিরল। তবে জেলার ছােট ছােট বনজঙ্গল কিংবা ঘন ঝোপঝাড়ে ছােট ছােট বাঘ মাঝে মধ্যে জনতার হাতে মারা পড়ে। তবে সীমান্ত সংলগ্ন পূর্বাঞ্চলে বন্য বানরের আধিক্য রয়েছে। এ জেলার পশুপাখির মধ্যে বেশির ভাগ পশু পাখিই গৃহপালিত। গৃহপালিত পশুর মধ্যে গরু, ছাগল, ভেড়া জেলার সর্বত্র চোখে পড়ে। ঘােড়া ও মহিষের অস্তিত্ব অনেকটা সীমাবদ্ধ। জেলায় কুকুর ও বিড়াল যথেষ্ট দেখা যায়। সরাইল থানার গ্রে হাউন্ড কুকুর (দেওয়ান সাহেবের বাড়ির কুকুর) অত্যন্ত উন্নত জাতের কুকুর, তাই দেশব্যাপী এই কুকুর সরাইলের কুকুর বা সরাইল্ল্যা কুকুর নামে খ্যাত। কথিত আছে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানী পাকবাহিনির গুপ্ত হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন এই কুকুরের বদৌলতে। হাঁস-মুরগি জেলার প্রধান গৃহপালিত পাখি। গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়িতেই হাঁসমুরগি পালন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় খুব উন্নত জাতের মুরগি পাওয়া যায় । এইসব মুরগি হাঁসলি বা আসিল মুরগি নামে খ্যাত। এইসব মুরগি দ্বারা মােরগের লড়াই খেলা চালানাে হয়। বর্তমানে এই মুরগি খুব চড়া দামে বিক্রি হয়ে থাকে। সারা দেশের মতাে এ জেলায়ও কাকের সংখ্যা বেশি। এছাড়া চিল, বাজপাখি, শকুন, মাছরাঙা, পানকৌড়ি, বিভিন্ন প্রকারের বক, কাঠঠোকরা, শালিক, ঘুঘু, বুলবুলি, ডাহুক, কৌড়া, চড়া, টুনটুনি, বউকথা কও, হলদে পাখি, শ্যামা, গুয়াক, বাবুই, কবুতর, আবাবিল ইত্যাদি হরেক রকমের পাখি দেখা যায়।

জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লা জেলা বাংলাদেশের প্রাচীন গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের অংশ বিশেষ নিয়ে গঠিত এবং মেঘনা নদীর পূর্বে অবস্থিত। বৃহত্তর কুমিল্লা জেলার আগেকার নাম ছিল ত্রিপুরা। অনেকে মনে করেন নামটি সন্নিহিত পার্বত্য ত্রিপুরা রাজ্যের নাম থেকে গৃহীত। বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পূর্বে ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। জেলার প্রাচীন ইতিহাস তমসাচ্ছন্ন। এখানে প্রথম বসতি স্থাপনকারীরা শান (Shan) জাতির বংশােদ্ভব তিব্বতী বর্মণ জাতি ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। ফ্রেডারিক মুলার ও অন্যান্য জার্মান নৃতাত্ত্বিক ব্রহ্মপুত্র বা লােহিত নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত বিবেচনা করে লােহিত জাতিভুক্ত করেছেন। প্রাক-আর্য গােষ্ঠীর কোনাে জাতিই তাদের অস্তিত্বজ্ঞাপক কোনাে লিপি বা গুহাবশেষ তথ্য হিসেবে রেখে যায়নি। আদি আর্যদের কাছে এ জেলা পাণ্ডববর্জিত দেশ হিসেবে পরিগণিত ছিল এবং  তাদের মহাকাব্য ও ধর্মশাস্ত্র গ্রন্থে এ অঞ্চলের গুরুত্বহীন উল্লেখমাত্র বিদ্যমান।

পুরাণ অনুসারে চন্দ্রবংশীয় জাতির বংশধর এবং সমাট বালির (Sukhma) নিজ  নামে পরিচিত ‘সুখমা’ নামক রাজ্য শাসন করতেন। এ রাজ্য ত্রিপ বলে অনুমিত হয়েছে। মহাভারতে উল্লেখ রয়েছে যে, বিখ্যাত পঞ্চপাণ্ডবের জানতে ভ্রাতা ভীম পূর্বাঞ্চলে এক অতর্কিত সমরাভিযান পরিচালনা করেন এবং সমতটে বসবাসকারী সুখমা ও ম্লেচ্ছ রাজাকে পরাজিত করেন। তবে খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীর পর্বে মেঘনা নদীর পূর্বদিকে ত্রিপুরা রাজ্যের কোনাে উল্লেখ পাওয়া যায় না। যদিও একথা সত্য যে, কৈলাসচন্দ্র সিংহ রচিত ‘রাজমালা’ বা ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস গ্রন্সে যযাতি বংশের প্রথম থেকেই বিবরণ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু এই ‘রাজমালা’র শুরু হয়েছে পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথম থেকে রাজা ধর্মমাণিক্যের রাজত্বের সময়ে। তাই এই সময়ের ও বহু পূর্বের ঘটনার নির্ভরযােগ্য বিবরণী হিসেবে তা গ্রহণযােগ্য হতে পারে না । রাজমালা অনুসারে ত্রিপুরা রাজ্য যযাতির পুত্র ত্রিপুরা কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত।

ত্রিপুরা রাজ্যের উপর ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রথমবারের মতাে আলােকপাত করা হয় পরিব্রাজক হিউয়েন সাং এর ভারত ভ্রমণের বিবরণীতে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে । তিনি লিখেছেন যে, সমুদ্র উপকূলবর্তী সমতট নামক দেশের উত্তর-পূর্ব দিকে পাহাড় ও উপত্যকার মধ্যে চি-লিচা-তালে (শ্রীকচ্ছত্র) রাজ্য, এর পরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে উপকূলের উপরে কিয়ানাে-লেনি-কিয়া (কমলাঙ্ক রাজ্য এবং আরও দক্ষিণে আছে তল-প-তি (দরপতি) রাজ্য। এই কমলাঙ্ক সাধারণত কুমিল্লা বলে শনাক্তকৃত। ত-ল-প-তি সম্ভবত ত্রিপুরার কারণ তখনকার ত্রিপুরা কুমিল্লায় উত্তর ও পূর্ব দিকে অবস্থিত ছিল। বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রাচীন সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে সমতট রাজ্যের উল্লেখ রয়েছে। ষষ্ঠ শতাব্দীর সংস্কৃত জ্যোতিষ গ্রন্থ ‘বৃহৎসংহিতা’য়ও সমতটের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুপ্রসিদ্ধ চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনসাং (উয়ান চোয়াং) সমতট সমুদ্র তীরবর্তী নিম্ন আদ্রভূমিখণ্ডরূপে বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীকালে সমতটকে রাজ্যের ত্রিপুরা জেলার সঙ্গে সম্পর্কের বিষয় একাদশ শতাব্দীতে ১ম মহীপাল দেবের রাজত্বকালে প্রতিষ্ঠিত বাঘাউড়া (নবীনগর) বিষ্ণুমূর্তির পাদদেশে উৎকীর্ণ লিপি থেকে এবং ১২৪৩ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ দামােদর দেবের মেহার তাম্রশাসন থেকে সুস্পষ্টরূপে অবগত হওয়া যায় ।

ডক্টর নীহার রঞ্জন রায় লিখেছেন যে, সমতট নিঃসন্দেহে দক্ষিণ ও পূর্ববঙ্গের কিয়দংশ, ত্রিপুরা অঞ্চল যার কেন্দ্র। (বাঙালির ইতিহাস, পৃ. ৪৪৬)। ৩ খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে সমতটে বৌদ্ধধর্ম যে উন্নয়নশীল অবস্থায় ছিল, ‘ বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক হিউয়েনসাং-এর বিবরণী থেকে প্রমাণিত হয়। তার এ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায় যে, সমতট রাজ্যে তখন ত্রিশটির অধিক বৌদ্ধ বিহার ছিল ৭১ – সেখানে দুহাজারেরও অধিক ভিক্ষু বাস করতেন

খ্রীস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে সমতট রাজ্যে হিন্দু ,বৌদ্ধ ও জৈন এই তিনটি প্রধান ধর্মাবলম্বী জনগণ পরস্পর বন্ধুত্ব ও প্রীতির সঙ্গে সহাবস্থান করতেন। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ নবীনগরের বাঘাউড়া গ্রামে ‘ভাণ্ডারির একটি প্রাচীন জলাশয় খননকালে একটি বিষ্ণমৰ্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। মর্তির পাদমলে যে লিপিটি আছে, তা থেকে জানা যায় যে, নপতি মহিপাল দেবের রাজত্বের তৃতীয় বর্ষে সমতট রাজ্যের অন্তর্গত বিলকেন্দুয়াই নিবাসী লােকদত্ত নামক জনৈক বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী বণিক কর্তৃক তদীয় মাতা : পিতার ও স্বকীয় পূণ্যফল বৃদ্ধির জন্য এই নারায়ণ মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকটবর্তী একটি গ্রাম এখনাে বিলকেন্দুয়াই নামে পরিচিত।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার এই বিলকেন্দুয়াই একটি প্রাচীন গ্রাম। এ গ্রামের উত্তর-দক্ষিণে লম্বা অতি প্রাচীন একটি জলাশয় রয়েছে। জলাশয়ের উত্তর পাড় সংলগ্ন উঁচু ভূমিটি বর্তমানে মুসলমানদের কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। এখানে প্রাচীনকালের ইট পাথর ও ইটের তৈরি দেওয়ালের ভিত্তি পাওয়া গেছে। ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে, এখানে কোনাে বৌদ্ধবিহার বা মন্দির ছিল। নবীনগর থানার কুড়িঘর গ্রামের পূর্বে রয়েছে কুড়িঘর বিল, এর উত্তরে তিতাস নদী এবং পশ্চিমে মেঘনা নদী। কুড়িঘরের ভৌগােলিক অবস্থান থেকে অনেকে মনে করেন যে, উপমহাদেশে মুসলিম রাজত্বকালে এখানে মােঘলদের একটি নৌঘাটি ছিল।”

আখাউড়া রেলওয়ে জংশনের দক্ষিণে দেবগ্রাম নামে লালমাটির একটি প্রাচীন গ্রাম রয়েছে। ব্রিটিশ রাজত্বকালে ১৯৩২ সালে জাপান থেকে এক জন বৌদ্ধ ঐতিহাসিক এসেছিলেন দেবগ্রাম দেখার জন্য। আখাউড়া রেলওয়ে স্কুলের শিক্ষকদের সাথে আলােচনাকালে তিনি দেবগ্রাম আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে, প্রাচীন বৌদ্ধ ইতিহাস গ্রন্থে কুমিল্লার ময়নামতির বৌদ্ধ সভ্যতার সমসাময়িককালে দেবগ্রাম বৌদ্ধ সভ্যতার একটি কেন্দ্র বলে উল্লেখ রয়েছে। দেবগ্রামের মাটির নিচে প্রাচীন যুগের বহু ইটের সন্ধান পাওয়া গেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চলে টিলাময় চম্পকনগরও একটি প্রাচীন গ্রাম। এখানে প্রাচীন যুগের ইট ও প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। চম্পকনগরে চন্দ্রবংশীয় (১০ম শতক) বৌদ্ধধর্মের রাজাদের রাজপ্রাসাদ ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন। দশম শতকের শুরু থেকে একাদশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত চন্দ্রবংশীয় রাজারা এ অঞ্চলে শাসন করেছিলেন। রাজা গােবিন্দচন্দ্র বা গােপীচন্দ্র স্বীয় রাজধানী চম্পকনগর থেকে কুমিল্লার নিকটে রােহিতাগিরিতে (লালমাই) স্থানান্তর করেন এবং রানী ময়নামতির নামানুসারে এর নামকরণ করেন ময়নামতি। চম্পকনগরে যে শিলাখণ্ড এবং প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে তা চন্দ্রবংশীয় রাজাদেরই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ বলে অনুমান করা হয়।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত আওলিয়াঝুড়ি নামে শুকিয়ে যাওয়া একটি নদীর তীরে এই প্রাসাদের ভগ্নাবশেষ পাওয়া গেছে। আওলিয়াঝুড়ি অর্থ দরবেশের নদী। এই [ নামের সঙ্গে এখানে মুসলিম আওলিয়া দরবেশদের আগমন এবং ইসলাম প্রচারের ঘটনাও জড়িত]। মুসলিম শাসকদের প্রভাবে এখানে বােদ্ধ ধমাবলম্বাদের বিলুপ্তি ঘটে। তবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা শেষ পর্যন্তও তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়।

১২০৫ খ্রিস্টাব্দে তুর্কি আক্রমণকারী ইখতিয়ার-উদ্দিন-মুহম্মদ-বিন-বখতিয়ার খিলজি কর্তক রাজা লক্ষণ সেনের রাজধানী নদীয়া অধিকারের ফলে সেনবংশের উপর মরণঘাত পড়ে। এই অভিযানের ফলে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ বঙ্গ মুসলিম অধিকারে আসে। কিন্তু ত্রয়ােদশ শতকের সমাপ্তি না ঘটা পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গ তাদের অধিকারে আসে নি। খুব সম্ভবত এতদঞ্চলের অসংখ্য নদী-নালা তুর্কি অভিযানের সম্মুখে শতাব্দীকাল বাধার সৃষ্টি করে রেখেছিল। তবে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পর্যায়ক্রমে পূর্ববাংলার বিভিন্ন এলাকাসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তার বিস্তার ঘটে।

১৬১৮ সালে মােঘল রাজত্বকালে পার্বত্য ত্রিপুরার উদয়পুর রাজধানী আক্রান্ত হয়েছিল । মােঘল সেনাপতি দাউদ খাঁর নেতৃত্বে মােঘলবাহিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চান্দুরা হয়ে হরষপুরের উপর দিয়ে উদয়পুর আক্রমণ করেছিলেন। সেনাপতি দাউদ খাঁ যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে যাননি। চান্দুরার দু’মাইল দক্ষিণে সাতগাঁও গ্রামে তিনি বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তার খনন করা কয়েকটি দিঘির স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে। দাউদ খা’র নামানুসারে দাউদপুর পরগনার নামকরণ করা হয়েছিল। সেখানে দাউদপুর নামে একটি গ্রামের অস্তিত্ব এখনাে রয়েছে। ভারতে মুসলিম রাজত্বকালে এ জনপদ মুসলিম রাজত্বের অধীনে ছিল। পাঠান সুলতান শের শাহ’র রাজত্বকালে রাজস্ব আদায় এবং শাসনকার্য পরিচালনার সুবিধার্থে এখানে পরগনার সৃষ্টি করা হয়।

ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় দেওয়ানি লাভ করার পর রাজস্ব আদায় এবং প্রাশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য পরগনার পরিবর্তে জেলা ও মহকুমার সৃষ্টি করে। ১৭৯০ সালে ত্রিপুরা জেলা গঠিত হয়। ১৮৬০ সালে গঠন করা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা । সরাইল, দাউদপুর, বেজুরা ও হরিপুর পরগনাকে ময়মনসিংহ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও নূরনগর এবং বরদাখাত বা বরদাখাল পরগনাকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৮৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়।

মােঘল আমলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে উন্নতমানের মসলিন কাপড় তৈরি হতাে। এ তথ্য জানা যায়, ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত ডাব্লিউ ডাব্লিউ হান্টার রচিত এ স্ট্যাটিসস্টিক্যাল একাউন্টস অব বেঙ্গল গ্রন্থের ভলিউম-৬ থেকে। হান্টার লিখেছেন, গত শতাব্দীর শেষ পাদে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার সরাইলে তানজেব নামে এক ধরনের অতি উৎকৃষ্ট মসলিন কাপর তৈরি হতাে। এই তানজেব মসলিন ঢাকার শবনম মসলিনের সমকক্ষ ছিল । ব্রিটিশ সরকার তাদের নিজেদের পণ্য এদেশে বাজারজাত করার জন্যে ঢাকার মসলিনের পাশাপাশি সরাইলের তানজেব মসলিনও বিলুপ্ত করে দেয়

জেলার জনবসতির পরিচয়

বাঙালি এক শংকর জাতি। বহু রক্ত ধারার সংমিশ্রণে যে বাঙালির দেহ গড়ে উঠেছে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধিবাসীদের সম্পর্কেও একই মন্তব্য প্রযােজ্য। তবে জেলার অধিবাসীদের এক বিরাট অংশের নৃতাত্ত্বিক ও জাতিতাত্ত্বিক উদ্ভব একান্তই তর্কসাপেক্ষ। নৃতত্ত্ববিদগণ গবেষণায় যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন তা অনেকটাই অনুমানমূলক কিছু সংখ্যক নৃতত্ত্ববিদ আদিম উপজাতিদের নিয়ে গভীর আলােচনা করেছেন সত্যি, কিন্তু সমগ্র অধিবাসীর জাতিতাত্ত্বিক উদ্ভব নিয়ে। প্রচুর অনুসন্ধানের অবকাশ রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্যাদির ভিত্তিতে বলা যায়, এ জেলার অধিকাংশই তিব্বত-ব্রহ্মদেশীয় বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণযুক্ত প্রাক আর্যগােষ্ঠীভুক্ত। পরবর্তী উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্য হলাে ইন্দোআর্যগােষ্ঠীর গুণাবলি। গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা, প্রশস্ত ললাট, সরল ও কোমল কেশরাজি, মাথার খুলির বিশিষ্ট গড়ন ইত্যাদির অধিকারী জেলার অধিকাংশ অধিবাসীই আর্য বংশােদ্ভূত হওয়ার পরিচয় বহন করে। তুর্কি, সেমেটিক এবং পারস্যদেশীয় উপাদানসমূহ এ এলাকাতে মুসলমান আধিপত্য বিস্তারের সঙ্গে সূচিত হয়েছে !

এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন জাতির পারস্পরিক মিশ্রণের ফলে জাতিগত বিশুদ্ধি আর নেই বললেই চলে। সাধারণত সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের সঙ্গে জাতিগত বিন্যাসকে একীভূত করা চলে না, কারণ ধনদৌলত এবং সম্পত্তির মালিকানাকে কেন্দ্র করেই সমাজের শ্রেণিবিভাগ হয়ে থাকে। আবার শাসকবর্গের পরিবর্তন অথবা অন্য কোনাে বিপ্লবাত্মক ঘটনার ফলে ধনদৌলত এবং সম্পত্তির মালিকানারও পরিবর্তন ঘটে।

এ জেলার অধিবাসীদের দৈহিক আকৃতি বিভিন্ন জাতির রক্তের মিশ্রণের কথাই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে। এখানে সােজা অথবা কোঁকড়ানাে চুল, উন্নত নাক, প্রশস্ত ললাট এবং গৌর বর্ণ বিশিষ্ট মানুষ যেমন দেখা যায়, তেমনি কৃষ্ণবর্ণ, স্থূল নাসিকা এবং উঁচু চোয়ালের হাড়বিশিষ্ট মানুষও চোখে পড়ে। অবশ্য এরা মজবুত গড়নের, মাঝারি ধরনের এবং গড়ে প্রায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট। সাধারণত স্ত্রীলােকেরা অপেক্ষাকৃত খাটোমানের হয়ে থাকে ।

এ জেলায় আদিবাসী বিরল। তবে কোনাে কোনাে এলাকায় মােঙ্গলীয়জাতির বৈশিষ্ট্য সংবলিত পার্বত্য উপজাতির ছােট ছােট গােষ্ঠী দেখা যায়। এরা ‘টিপরা এবং ‘ঋষি’ নামে পরিচিত। বাঙালি প্রতিবেশিদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত চলাফেরার ফলে তাদের উপজাতিগত বৈশিষ্ট্যগুলাে প্রায় লােপ পেতে চলেছে।

জেলার বর্তমান জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই মুসলমান। এরপরই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের স্থান। হিন্দু এবং মুসলমান, এই উভয় সম্প্রদায় ছাড়া জেলায় বসবাসকারী খুবই স্বল্পসংখ্যক খ্রিস্টান রয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোনাে ধর্মাবলম্বীর অবস্থান এ জেলায় নেই বললেই চলে। তবে দীর্ঘদিন ধরে একসঙ্গে বসবাস এবং চলাফেরার কারণে পরস্পরের মধ্যে একটা যােগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। এই যােগসূত্র লক্ষ করা গেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় । তখন প্রায় সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে

শ্লোগান দিয়েছে, তুমি কে, আমি কে- বাঙালি, বাঙালি’, ‘তােমার আমার ঠিকানাপদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ ইত্যাদি। এই ঐক্যসূত্রের মাধ্যমেই বাঙালি জাতি এদেশ স্বাধীন করেছে। বিকাশ ঘটেছে বাঙালি জাতিসত্ত্বার। বাঙালি জাতীয়তাবাদ হয়েছে এ জাতির। মূল পরিচয়।

তবে নৃতত্ত্বের বিচারে এ জেলার সকল অধিবাসীই যে বিভিন্ন রক্তধারার সংমিশ্রণে গঠিত এক শংকর জাতি, তা আগেই বলা হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিককালে এ জেলায় ভেজ্ঞিদের বসবাস ছিল। বহুকাল ধরে এ অঞ্চলে বসবাস করে তারা নিজেদের সমাজ ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিল। তার পর আসে এখানে আলপাইন বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নরগােষ্ঠীর লােকেরা। তারা আর্য নরগােষ্ঠীর লােক হলেও বৈদিক আর্য বা আদি নার্ডিকদের থেকে ভিন্ন মানুষ ছিল । এদের প্রভাবে এ জেলার অধিবাসীরা এক শঙকর জনে পরিণত হয়। আদিবাসীদের মধ্যে যে বৃত্তিভিত্তিক বর্ণবিন্যাস ছিল, তা অনুমান করা যায় । কিন্তু এই বহিরাগতদের সংমিশ্রণে যে বর্ণবিন্যাস গড়ে ওঠে, তা বৃত্তিভিত্তিক থাকলেও তাতে নৃতত্ত্বের অবদানও যথেষ্ট ছিল বলে মনে হয় এবং যে বর্ণের মধ্যে বহিরাগতদের রক্ত অধিক পরিমাণে মিশ্রিত হয়েছিল, তারাই খুব সম্ভবত উঁচু বর্ণ বলে বিবেচিত হতাে।

এরপরে বৈদিক আর্যদের আগমন ঘটে এখানে। বৈদিক আর্যদের রক্তের মিশ্রণ এ জেলার অধিবাসীদের মধ্যে খুব বেশি ছিল না। তবে তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব যথেষ্ট ছিল। সেই প্রভাবের ফলে এ জেলার অধিবাসীদের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবন নতুনভাবে গড়ে ওঠে ! যে বর্ণবিন্যাস প্রথা আগে থেকেই চালু ছিল, তা বিধি-নিষেধের চার দেওয়ালে আবদ্ধ হয়ে আরও দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠে।

তার পর আসে মুসলমানদের প্রভাব। এর আগে অবশ্য কিছু কিছু মােঙ্গোলীয় নরগােষ্ঠীর প্রভাব এ জেলার অধিবাসীদের ওপর পড়ে। কিন্তু তা খুব ব্যাপক ছিল বলে মনে হয় না। বরং মুসলমানদের আমলেই সে প্রভাব অপেক্ষাকৃত অধিক কার্যকরী ছিল বলে ধারণা করা যায়। মুসলমানদের প্রভাবে এ জেলার নৃতত্ত্বের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়। পশ্চিম দেশগুলাে থেকে আগত বহু মুসলমান এ জেলায় স্থায়িভাবে বসতি স্থাপন করে এবং সেইসঙ্গে এদেশের বহু অমুসলমানও নতুন ধর্মে দীক্ষিত হয়। এই স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলমানেরা এ জেলার আদিবাসী। বহিরাগত ও স্থানীয় ধর্মান্তরিত মুসলমান, কিছু কিছু অমুসলমান এবং মােঙ্গোলীয় নরগােষ্ঠীর কিছু কিছু রক্তধারার সংমিশ্রণে গড়ে উঠে এ জেলার মুসলমানজনেরা। তাই গােটা বাঙালি জাতির মতাে এ জেলার অধিবাসীরাও এ শংকর জন। পেশাভিত্তিক বিবর্তনের দিক থেকে দেখা যায়, আদিকাল থেকেই এ জেলার অধিকাংশ লােকের প্রধান পেশা চাষবাস মাছধরা। এককালে কৃষিশ্রমিক ও দিনমজুর হিসেবে কাজ করত বহু লােক। ঘরামি, কামার, কুমাের, স্বর্ণকার, রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি ও তাতিদের একসময় দক্ষ শ্রমিক হিসেবে গণ্য করা হতাে। তাঁতবােনা, মাছধরার জাল তৈরি, মাটির হাঁড়িকুড়ি ও কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করা, ঝুড়িবােনা, মাদুরবােনা এবং মাছধরা অনেক ক্ষেত্রে সহকারী পেশা হিসেবে গহীত হতাে। বিভিন ঋতুতে কাজ পাওয়ার আশায় অনেকেই অন্য জায়গা বা জেলায় চলে যেত। এক শ্রেণির ভূমিহীন পুরুষ শ্রমিক শীতকালে অন্য জায়গায় স্থায়ীভাবে কাজের সন্ধানে গিয়ে সেখানে ছুতাের। মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করত। চাষ আবাদের আসল সময়ে জেলার কৃষিশ্রমিকরা প্রায় সারা দিনই ক্ষেতে খামারে কাজ করে। স্ত্রীলােক ও ছেলেমেয়েররা মাঠে কাজ না করে সাধারণত ঘর-কন্যার কাজকর্মই করত। কৃষকের বৌ ও ছেলে-মেয়েরা তাদের গৃহস্থালি সংক্রান্ত কাজের ফাকে গরু, বাছুর, ছাগল ইত্যাদি গৃহপালিত পশু এবং হাঁস মুরগির পরিচর্যা করা, শস্য ঝাড়াই-মাড়াই, রােদে দেওয়া, তুষ ঝাড়াবাছা এবং শস্য গােদামজাত করার কাজও করত। কাপড়বােনা, মাটির হাঁড়ি-কুড়ি তৈরি করা, মাদুর ও ঝুড়িবােনা ইত্যাদি কুটিরশিল্পে স্ত্রীলােকেরা তাদের স্বামীর মতােই সমান ভূমিকা পালন করত। মাঝির পেশায় নিয়ােজিত থেকেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করত।

হিন্দুধর্মের বর্ণভেদ প্রথার কারণেও এখানে পেশাভিত্তিক বিভিন্ন গােষ্ঠী গড়ে উঠেছে। যেমন জেলে, কামার, কুমার, ছুঁতার, মুচি, যােগী বা তাঁতি, মেথর, নাপিত, শাঁখারি, সূত্রধর ইত্যাদি। পাশাপাশি হিন্দুধর্মের ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং মুসলমান ধর্মের পীরবাদকে অবলম্বন করেও এককালে অনেকে জীবিকা নির্বাহ করত। এ ধারা সম্প্রতি অনেকটা কমলেও একেবারে লুপ্ত হয়নি। হিন্দুধর্মের মতাে মুসলমান সমাজে কোনাে অন্ত্যজ, অপাঙক্তেয় বা অস্পৃশ্য শ্রেণির মানুষের অস্তিত্ব থাকার কথা নয়, তবে বাংলাদেশে তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ ধরনের কিছু কিছু লােক বা গােষ্ঠী যে ছিল এবং এখনাে আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে এদের সঙ্গে এ জেলার অন্যান্য মুসলমানদের কোনাে পার্থক্য সাধারণত চোখে পড়ে না। কিন্তু মুসলমান সমাজে এরা ঠিক অস্পৃশ্য না হলেও, অপাঙক্তেয় যে ছিল তাতে সন্দেহ নেই। তাদের মধ্যে বাদ্যকর বা নাকাড়চি, হাজাম, গাইন, বেদে প্রভৃতি সম্প্রদায় বা গােষ্ঠীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

তবে শিক্ষা-দীক্ষায় ক্রমােন্নতির ফলে এখানকার মানুষের পেশার ক্ষেত্রেও নানা পরিবর্তন ঘটেছে। কৃষক, শ্রমিক, জেলে, মাঝি, কামার, কুমাের, তাঁতি, বাদ্যকর, হাজাম, নাপিত প্রভৃতি পেশাভিত্তিক সমাজের ছেলেমেয়েরাও আজকাল লেখাপাড়ায় শিক্ষিত হয়ে নানান ব্যবসায়-বাণিজ্য এবং সরকারি বেসরকারিভাবে চাকরিক্ষেত্রে নিয়ােজিত হচ্ছেন। দেশে কলকারখানা বাড়ার সাথে সাথে শ্রমিকরাও স্থায়ী চাকরি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে তাদের দক্ষতা বাড়াচ্ছেন। যানবাহন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা উন্নত হওয়ার সাথে সাথে অনেক পেশা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার অনেক পেশায় নতুনমাত্রা যােগ হয়েছে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের সাথে সাথেও এখানে নতুন নতুন পেশার সংযােগ ঘটেছে। তবে জেলার অধিকাংশ মানুষরেই প্রধান পেশা চাষবাস বা কৃষিকাজ। এই কৃষিক্ষেত্রে ক্রমােন্নতি সাধিত হচ্ছে। দেশান্তরে গিয়েও অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন ।

নদ-নদী ও খাল-বিল

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান নদী তিতাস। নাসিরনগরের চাতলপাড় গ্রামের পাশ দিয়ে মেঘনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে তিতাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন এলাকায় একেবেকে প্রবাহিত হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে দীর্ঘপথ পরিক্রমার পর তিতাস পুনরায় আশুগঞ্জের লালপর ও নবীনগরের মানিকনগর এবং কৃষ্ণনগরের মধ্যবর্তী এলাকায় মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে। এর প্রবাহ অত্যন্ত আঁকাবাকা এবং দৈর্ঘ্য ১৫০ মাইলেরও বেশি। নাসিরনগর, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আখাউড়া, নবীনগর, বাঞ্ছারামপুর থানার (উপজেলার) বিভিন্ন এলাকা দিয়ে তিতাস প্রবাহিত। অসংখ্য শাখা-প্রশাখার সাহায্যে এ নদী দ্বারা। জেলায় উল্লেখযােগ্য অংশ প্লাবিত হয়। নদীটি বর্তমানে হাওড়া নদীর সঙ্গমস্থলে এবং কৃষ্ণনগরের অদূরে ভরাট হয়ে গেছে। এর তীরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ।

তিতাস ছাড়াও শালদা নদী, হাওড়া, বিজনা, বুড়িনদী, লােহর বা লাহুর, আওলিয়াজুড়ি, মালিয়াজুড়ি, পাগলি, লংঘন, লাওয়াই প্রভৃতি নদ-নদী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকা দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পশ্চিম প্রান্ত ঘেঁষে প্রবাহিত হয়েছে দেশের বৃহত্তর নদী মেঘনা। জেলার প্রধান প্রধান খালের মধ্যে কুরুলিয়া, গােকর্ণখাল, আড়াইল জোড়, কাডাঙ্গি, কাটাখলা, কুকুরিয়া, কোদালিয়া, খাল্লা, গােয়ালখলা, ডিংজুরি, জাফরখাল, ডাঙ্গি, পনার খাল, ফারেঙ্গা, মহাখালি প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

জেলার জমি-জরিপ সম্পর্কিত বিতরণীতে (১৯১৫-১৯১৯) ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিলগুলাের উল্লেখ রয়েছে। তেলিকান্দি ও জয়ধরকান্দি থেকে চুন্টা, কালীকচ্ছ ও নােয়াগাঁও গ্রামের উত্তরে এবং মহিষবেড়, কুণ্ডা, গােকর্ণ, জেঠাগ্রাম, বিল শাপলা, শাহজাদাপুর, ফুলঝুরি, হরিপুর, ধাউরিয়া ও বুধন্তি। গ্রামে বড় বড় বিলেরমালা সৃষ্টি হয়েছে। তিতাস নদী এ এলাকার মধ্য দিয়েই প্রবাহিত। তিতাসের স্রোতহীন অসংখ্য শাখা এ এলাকার অনেক জায়গাতেই সারা বছর জল ধরে রাখে। ফলে নিম্নভূমি ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে আসছে। এ কারণে তিতাস গ্রীষ্মে যেমন বহু জায়গায় বিভক্ত হয়, তেমনি বর্ষাকালে সংযুক্তও হয়। শুষ্ক মৌসুমে পৃথক দৃশ্য চোখে পড়ে। তখন বিস্তৃত নিম্নভূমিতে ধানের চাষ হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ঠিক উত্তরে অনেকগুলাে বিলের একটি বৃত্ত বিদ্যমান। সেসব বিল নাসিরনগর, নাসিরপুর, আশুরাইল গ্রামের উত্তরাংশ এবং শ্রীধর ও বুড়িশ্বর গ্রামের পশ্চিমাংশ জুড়ে রয়েছে। এই এলাকার পরিমাণ প্রায় ১০বর্গমাইল এবং শীতের মৌসুমে এর প্রায় সবটাই শস্যক্ষেত ও গােচারণ ভূমিতে পরিণত হয়। বর্ষাকালে এলাকাটি একটি বিস্তৃত জলাশয়ের রূপ নেয়, তখন তাকে বলা হয় মেদির হাওর । অবশ্য শুষ্ক মৌসুমেও এর অধিকাংশ এলাকা এ নামেই পরিচিত হয়। হাওর’ শব্দ ‘সাগর’ শব্দের বিকৃত রূপ । লহর বা লাহুর নদীর উত্তর তীর বরাবর অনেক বিল রয়েছে। চান্দুরা থেকে তিতাসের বাম তীর বরাবর রয়েছে এক বিস্তৃত নিম্নভূমি । তিতাসের সমান্তরাল দীর্ঘ খালগুলােরও বর্ষব্যাপী জল থাকে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের সাথে আশুগঞ্জ, আখাউড়া, কসবা এবং বিজয়নগর উপজেলার রেলযােগাযােগ রয়েছে। আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া ও কসবার ওপর দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম এবং আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আখাউড়া ও বিজয়নগরের ওপর দিয়ে ঢাকা-সিলেট রেললাইন প্রবাহিত হয়েছে। সড়কপথে জেলার কসবা, আখাউড়া, সরাইল, নাসিরনগর, বিজয়নগর এবং আশুগঞ্জের সাথে রয়েছে সহজ যােগাযােগ।

ঐতিহাসিক স্থাপনা ও স্থান

হযরত কাজী মাহমুদ শাহের (র.) দরগা : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ইতিহাস ঐতিহেরে সঙ্গে যাদের নাম সর্বাগ্রে জড়িয়ে আছে হযরত কাজী মাহমুদ শাহ (র.) তাদের অন্যতম। তিনি একজন দরবেশ ও ইসলাম প্রচারক। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজীপাড়ায় তাঁর দরগা ও মাজার অবস্থিত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামকরণের সঙ্গে এই দরবেশের সংশিষ্টতার একটি জনশ্রুতি এখানে বহুল প্রচারিত । জনশ্রুতিটি হচ্ছে মােঘল শাসনামলের কোনাে একসময়ে এই ধর্মপ্রচারক ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসে বসতি গড়েন। স্থানীয় জনসাধারণ তার অনেক আধ্যাত্মিক গুণে মুগ্ধ হন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসরত ব্রাহ্মণরাও উক্ত দরবেশের অলৌকিক ক্ষমতায় বিস্মিয়াবিষ্ট হন। একপর্যায়ে তারা তাদের বিরােধিতার কারণে দরবেশের কাছে ক্ষমা চেয়ে নবীনগরের বিদ্যাকুটে চলে যান। এভাবে ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাওয়া থেকে এলাকার নামকরণ হয় ব্রাহ্মণবেড়িয়া> ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গবেষক মুহম্মদ মুসা লিখেছেন এই সাধক কর্তৃক ব্রাহ্মণ পরিবার বিতাড়িত হয়েছিল। দরবেশ ব্রাহ্মণ বেরিয়ে যাও’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। তার সেই উক্তি থেকেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামের উৎপত্তি। প্রখ্যাত গবেষক আ কা মাে যাকারিয়াও উল্লিখিত মত সমর্থন করেন। এই দরবেশের অনেক অলৌকিকতার কথা এখনাে লােকমুখে মুখে প্রচারিত। তার নামানুসারেই শহরের কাজীপাড়ার নামকরণ হয়েছে। এখানে তার একটি বিশাল দরগা ও মাজার আছে। একটি শিলালিপিতেও এই দরবেশের আগমন কাহিনি জানা যায়। প্রতিবছর এখানে এই দরবেশের স্মরণে ওরশ শরিফ অনুষ্ঠিত হয়।

মেড়ার কালভৈরব বিগ্রহ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পুরাতন মেড্ডাবাজার সংলগ্ন তিতাস নদীর তীরে কালভৈরব মন্দিরের অবস্থান। এ মন্দিরেই রয়েছে বিখ্যাত কালভৈরব বিগ্রহ। প্রায় দুইশ বছর পূর্বে দুর্গাচরণ আচার্য নামে একজন মৃৎশিল্পী সারাদিষ্ট হয়ে এই কালভৈরব মূর্তিটি তৈরি করেন। প্রথমে এটি তিতাস নদীর তীরে পঞ্চবটি মূলে স্থাপন করা হয়। দিনে দিনে বিশাল এই বিগ্রহটির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। যাত্রাপথে হরষপুরের তৎকালীন জমিদার নুরালী এই বিগ্রহ দেখে এর জন্যে একখণ্ড নিষ্কর ভূমি দান করেন। সেই ভূমিতেই গড়ে ওঠে বিখ্যাত কালভৈরব মন্দির। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তি লাখীরাজচন্দ্র সাহা তার পত্নী মহামায়া সাহার স্মৃতি রক্ষার্থে ১৩১৬ বাংলা সনে কালভৈরব মন্দিরের টিনের চাল ভেঙে পাকা ছাদ নিমাণ করে দেন।

আসনে বসা কালভৈরবরূপী শিব মূর্তিটির উচ্চতা ২২ ফুট। শিবমূর্তির পাশে আন্ত শিবের স্ত্রী পার্বতীর মূর্তি। ১৩৪৪ সনে কালভৈরব মূর্তিটির একটি অংগ দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ মতাে অবস্থায় স্থানীয় ভক্তদের সহায়তায় কলকাতার প্রখ্যাত ভাস্কর সচ্চিদানন্দ সেন রড সিমেন্টের ঢালাইযােগে এটি নির্মাণ করেন। ১৯৭১ সনে পাকবাহিনি ডিনামাইট দিয়ে মূর্তিটি ধ্বংস করে দেয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সনে এটি আবার পুনঃনির্মাণ করা হয়।

ভাদুঘর শাহী জামে মসজিদ : ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রাচীনতম মসজিদগুলাের অন্যতম ভাদুঘর শাহী জামে মসজিদ। বর্তমান পৌর এলাকার ভাদুঘর গ্রামে মােঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়কালে এই মসজিদটি নির্মিত হয়। মসজিদের মূল ভবন গম্বুজ প্রভৃতি মােঘল নির্মাণ শৈলীর অনন্য প্রমাণ। মসজিদের অভ্যন্তর দেওয়ালে সে যুগের লতাপাতা ও অন্যান্য কারুকাজের নিদর্শন আছে। বিভিন্ন সময়ে মসজিদ সংস্কারের ফলে এসব কারু নিদর্শনের অনেকই ঢাকা পড়ে গেছে। ভাদুঘর জামে মসজিদে ফার্সি ভাষায় লিপিবদ্ধ শিলালিপি পাওয়া গেছে। এর বঙ্গানুবাদ থেকে জানা যায়, মােঘল সম্রাট আলমগীর আওরঙ্গজেবের সময়ে তৎকালীন সরাইল পরগনার দেওয়ান বান্দাহ শাহবাজ ইবনে মজলিশ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। প্রখ্যাত প্রত্নবিদ ড. আহমদ হাসান দানী দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের বর্ণনা দিয়েছেন।

কেল্লা শাহিদ (র.)-এর মাজার : ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যে সকল অলি-আউলিয়া বঙ্গে আগমন করেন তাদের মধ্যে হযরত সৈয়দ আহাম্মদ গেছু দারাজ অন্যতম। কথিত আছে যে, হযরত শাহ জালাল (র.) যখন সিলেটে ৩৬০ জন আউলিয়া নিয়ে আগমন করেন তখন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। বিভিন্ন বর্ণনায় এ বিষয়ে মতভেদ দেখা যায়। তবে একথা নিশ্চিত যে, তিনি অত্যন্ত কামেল আউলিয়া ছিলেন। তার পবিত্র মাজার আখাউড়া থানার খড়মপুর গ্রামে অবস্থিত। বাংলাদেশের বহু দূরদূরান্ত থেকে ভক্তগণ তার মাজার জিয়ারত করতে আসেন।

সরাইলের আরফাইলের মসজিদ : সরাইলের আরফাইলের মসজিদটি এবং সংলগ্ন জোড়া কবরটি মােঘল স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। যদিও মসজিদটির নির্মাণ কাল এবং নির্মাতাদের কোনাে দলিল-পত্রাদি এখনাে পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে অনেক গাল-গল্প চালু আছে। মসজিদটির একটি কোণা ধসে যাওয়ায় একটি লােককাহিনি প্রচলিত হয় যে, মসজিদটি জ্বিনেরা, উঠিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল । কিন্তু সুবেহ সাদেক হয়ে যাওয়াতে তা আর সম্ভব হয়নি। সরাইল বাজার থেকে আনুমানিক দেড় মাইল পশ্চিমে মসজিদটি অবস্থিত। ৩ গম্বুজ ও ১৬ মিনার বিশিষ্ট মসজিটির আয়তন ৭০ ফুট × ২০ ফুট, দেওয়ালের পুরুত্ব ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। সামনের পাকা চত্বর ৫২ ফুট × ৩১ ফুট। চারপাশের দেওয়ালের ঘনত্ব ২ ফুট ৩ ইঞ্চি। শাহ আরি বা আরেফিন নামের কেউ এই মসজিদটি স্থাপন করেছেন বলে জনশ্রুতি আছে। সে অনুযায়ী মসজিদটির নাম আরফাইলের মসজিদ বলে অনুমান করা হয়। স্থাপত্য কলাকৌশলী ও অপূর্ব নির্মাণশৈলীর কারণে মসজিদটিকে দেখতে অনেকটা তাজমহলের মতাে বলে। মনে হয়। ৩৫০ বৎসর পূর্বে নির্মিত মসজিদটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননির্দশন । উনবিংশ শতাব্দীতে মুসলিম জমিদারগণ ও বিংশ শতাব্দীর এক পর্যায়ে কাশিম বাজারের হিন্দু জমিদার রাজা কমলা রঞ্জন রায় এর রক্ষণাবেক্ষণ করেছেন বলে জানা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্মতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের অধীন মসজিদটি প্রত্নসম্পদ হিসেবে ঘােষিত হয়েছে।

হাটখােলা বা আরফান নেছার মসজিদ : বর্তমানে সরাইল বাজারে মসজিদটি অবস্থিত। সরাইলের জমিদার বাড়ি থেকে এর দূরত্ব অল্প। মােঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে (১৬৫৮-১৭০৭) ১৬৬২ খ্রি. সরাইলের দেওয়ান নূর মােহাম্মদের স্ত্রী আরফান নেছা কর্তৃক মসজিদটি নির্মিত হয়। অন্য তথ্য মতে মজলিশ শাহরাজের পুত্র নূর মােহাম্মদ কর্তৃক ১০৭৩ হিজরি (১৬৫৩ খৃ.) মসজিদটি নির্মিত হয়। বলে বলা যায় মসজিদটির আয়তন ৪৫ ফুট × ১৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। দেওয়ালের পুরুত্ব ৪ ফুট ৫ ইঞ্চি। গম্বুজের সংখ্যা ৫টি। দু’পাশের সম্প্রসারিত বারান্দা ৬০ ফুট × ১৫ ফুট। সামনের পাকা চতৃর ৬০ ফুট x ১৫ ফুট। মসজিদটি নির্মাণের পর প্রথম ঈমাম হিসেবে নিযুক্ত হন দিল্লি থেকে আগত হাফেজ আবদুল কুদুস দেহলভি। মােঘল স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শনগুলাে সংস্কারের অভাবে অনেকাংশে বিনষ্ট হয়ে গেছে।

হাতিরপুল : ঢাকা-সিলেট বা কুমিল্লা-সিলেট রােডের সংলগ্ন স্থানে অর্থাৎ সরাইল থানার বারিউরা নামক বাজারের প্রায় একশত গজ দূরে ইট নির্মিত একটি উঁচু পুল বিদ্যমান । পুলটি সংস্কার করার ফলে এখন তা অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর থেকে পুলটিকে সংস্কার ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। পুলটি হাতিরপুল নামে পরিচিত। দেওয়ান শাহবাজ আলী সরাইলে দেওয়ানি লাভের পর বর্তমান শাহবাজপুরে তার কাচারি প্রতিষ্ঠা করেন। শাহবাজ আলী কার্যোপলক্ষে সরাইলের বাড়ি এবং শাহবাজপুর যাতায়াতের জন্য সরাইল থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন। রাস্তাটি ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে নির্মিত হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। রাস্তাটি পরিত্যক্ত অবস্থায় কুট্টাপাড়ার মােড় থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত এখনাে টিকে আছে। রাস্তাটিকে স্থানীয়রা জাঙ্গাল বলে থাকে। দেওয়ান শাহবাজ আলী এবং হরষপুরের জমিদার দেওয়ান নূর মােহাম্মদের সঙ্গে আত্মীয় সম্পর্ক ছিল বলে অনেকে মনে করে। ফলে উভয় পরিবারের যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে উক্ত জাঙ্গালটি ব্যবহৃত হতাে বলে মনে করা হয়। জাঙ্গালটির ওপরে পুলটি অবস্থিত। কথিত আছে, পুলটির গােড়ায় হাতি নিয়ে বিশ্রাম নেওয়া হতাে বলে পুলটিকে হাতিরপুল নামে অভিহিত করা হয়। পুলটির গায়ে অপূর্ব সুন্দর কারুকার্য করা ছিল। সংস্কারের সময় কিছু কারুকার্য নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। জাঙ্গাল হাতিরপুলের পাশ দিয়ে বর্তমান ঢাকা-সিলেট, চট্টগ্রাম-সিলেট রােডে চলে গেছে। হাতির পুলের নিচ দিয়ে ইংরেজ আমলেও নৌকা চলাচল করত বলে জানা যায়।

গির্জা : ব্রিটিশ শাসনকালে নিউজিল্যান্ডের একটি মিশনারি দল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইলে আবাসস্থল গড়ে তােলেন এবং একটি গির্জা প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের একমাত্র উপাসনালয়। সুন্দর নৈসর্গিক পরিবেশে গির্জাটির অবস্থান।

গোঁসাইল মন্দির : ভিটির দৈর্ঘ্য ৪৮ফুট ১০ইঞ্চি, প্রস্থ ২২ফুট ১০ইঞ্চি, উচ্চতা প্রায় সাড়ে তিন ফুট। মূল মন্দিরের দৈর্ঘ্য ১৪ফুট ১ইঞ্চি, প্রস্থ ৯ফুট ৬ ইঞ্চি। এ জোড় মন্দিরে দুইটি পাকা ঘরের আকৃতি ও মাপ একইরূপ। প্রতিটি মন্দিরে কুঁড়েঘরের মতাে দুটি ঢালু ছাদ। এ জোড়া-মন্দির জেলায় আর নেই। জোড়া মন্দিরে লােকজ উপাদানগুলাে বিদ্যমান। সাধারণ মানুষ হিন্দু-মুসলমান এ মন্দিরে পহেলা বৈশাখে সবাই মিলিত হয় পরম আনন্দে। মন্দিরের ছাউনির ওপর প্রথমে ফুলের টব তারপর কলস, প্রদীপদানি। সবার ওপরে ত্রিশূল দেওয়ালে বর্গাকার ও আয়তাকার ছাপ । পাকা পিলার খাজকাটা, দরজার ওপরে ফুল, লতা-পাতা, ফুলের টব ও বিভিন্ন আলপনা আঁকা । প্রতি মন্দিরের ভেতরে দুইটি জানালা, ভেতরে আয়তকার খুপড়ি আছে। যেগুলােতে প্রদীপ রাখা হয়। মন্দিরের প্রতিটি দরজার উচ্চতা ৫ফুট ৪ইঞ্চি দেওয়ার পুরুত্ব প্রায় আড়াই ফুট, মন্দিরের উচ্চতা আনুমানিক ২০ফুট। মন্দির স্থাপিত ৫৮৩ বঙ্গাব্দে। এটি ভুল তথ্য কারণ বাংলা সন প্রতিষ্ঠার আগেই তা দেখানাে হয়েছে। চুন ও সুরকির তৈরি এ জোড় মন্দির আনুমানিক দেড়শত বছরের পুরাতন। প্রকৃতপক্ষে মাটির মন্দির ৪শত বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ছিল বলে জনগণ জানান।

মইনপুর মসজিদ : কসবা উপজেলার এ মসজিদটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে। তিনটি গম্বুজ ও আটটি মিনার বিশিষ্ট মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আজমত আলী। আয়তন ৪১ ×২৩, দেওয়ালের ঘনত্ব ৪-৬, সামনের পাকা চতুর ৫৪×২৪। মােগল আমলের স্থাপত্য শৈলী যেমন বিদ্যমান তেমনি লােকজ উপাদানও এতে রয়েছে। প্রতি গম্বজে একটি কলস, তার উপরে পদ্মফুলের পাপড়ি সবার উপরে ফুলের কলি। মসজিদের ভেতরে আনারসের নক্সা, ৩টি দরজায় দরজায় লতা-পাতাফুল ও পাখার নকশা। মসজিদের ভেতরে দক্ষিণে ফুলের ঝাড়, লতা-পাতা-ফুল রঙধনুর মতাে বাঁকা উপরের দেওয়াল ।

বায়েক নারায়ণ মন্দির : কসবা উপজেলার বায়েক গ্রামে গােকূল ভট্টাচার্যের বাবা প্রায় দুইশত বছর পূর্বে এ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। সবশেষ যিনি এর দায়িত্বে ছিলেন তার নাম লালু ভট্টাচার্য্য। তিনি ১৯৬৩-৬৪সালে বায়েক ত্যাগ করেন। ব্যতিক্রমধর্মী এ মন্দির দ্বিতল বিশিষ্ট উপরের ছাদটি কুঁড়ের ঘরের মতাে ছাউনি। ছাদের কার্নিশ উপরে ও নিচে বাঁকানাে। মন্দিরের পূর্বদিকে ওপরে যাওয়ার সিঁড়ি। ছাদের নিচে লতাপাতা ফুল দিয়ে সাজানাে, বিভিন্ন মূর্তি ও সাপের ছবি যেগুলাে ধ্বংস হয়ে গেছে।

বায়েক শিবমন্দির : এ মন্দির প্রায় দেড়শত বছর পূর্বে নির্মিত হয়েছিল । দেওয়ালের গায়ে লতা-পাতা-ফুল, শীতল পাখা, বিভিন্ন আলপনা, মূর্তি ও শীর্ষভাগে কলস রয়েছে।

উজানিসার মন্দির : ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থেকে ২০ কি.মি দক্ষিণে উজানিসার। গ্রাম। এ গ্রামের মন্দিরটিতে কিসের পূজা হতাে তা মুরুব্বীরা বলতে পারেনি। এ গ্রামের আদি বসতি রায় ও খা’র পরিবার। আদি বসত স্থাপন করেন রূপচান রায় ১৯৪৭ সালের পর এ গ্রামের মেহুর চান ও তার মেয়ে আরজু বানু মন্দিরটি দেখাশােনা করেন। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ২০ফুট ৮ইঞ্চি, প্রস্থ ১৯ফুট ১০ইঞ্চি, দেওয়ালের পুরুত্ব ৪ফুট ৩ইঞ্চি। উচ্চতা আনুমানিক ৪০ফুট। ৪টি খিলানে মন্দির নির্মিত। প্রতিটি খিলান ষড়ভূজ অর্ধবৃত্তাকার। কুঁড়ের ঘরের মতাে ছাদ ও কার্নিশ বাঁকানাে। কিন্তু মন্দিরটি চৌচালা। পশ্চিমে ১টি দরজা, দক্ষিণে ১টি জানালা। লােকজ উপাদান সম্পৃক্ত শুধু ছাদ নয়, এ মন্দিরে দক্ষিণে ছােট একটি মন্দিরের মতাে ছিল । তাতে ওঠার জন্য সােপান ছিল। ছােট মন্দিরটিতে চৌচালা ছাদ ছিল । মূল মন্দিরের ওপরে একটি ত্রিশূল ছিল । মন্দিরের ভেতরে-বাহিরে লতা-পাতা, ফুল, বিভিন্ন মূর্তি, আলপনা ও নকশা ছিল । মন্দিরের বয়স আনুমানিক ৩শত বছর। এ জেলার সবচেয়ে প্রাচীন স্থাপত্য । আমি জহিরুল ইসলাম চৌধুরী স্বপন ১৩এপ্রিল কসবা সদর থেকে ৬কি.মি. উত্তরে চণ্ডীদ্বার গ্রামের বীর মুক্তিযােদ্ধা, শিক্ষক মতিলাল বণিকের (৭০) সঙ্গে কথা বলি। তিনি আমাকে গোঁসাইস্থল জোড়া মন্দির, বায়েক নারায়ণ মন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের উজানিসার মন্দিরে থাকা বিভিন্ন নকশা ও লােকজ উপাদান নিয়ে কথা বলেন। ১৪এপ্রিল কসবা উপজেলার মইনপুর পূর্ব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মাে. মুজিবুর রহমান (৪০) এম.এ আমাকে মইনপুর জামে মসজিদের নকশা ও লােকজ উপাদান সম্পর্কে আমার সঙ্গে কথা বলেন।

রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্য সাধক

নবাব সিরাজুল ইসলাম (১৮৪৫-১৯২৩) : নবাব সিরাজুল ইসলাম ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে নবীনগর থানার পেয়ারাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ল’ পাশ করে তিনি কলকতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক পরিষদের সদস্য হন। তৎকালীন কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘দি মুসলিম পত্রিকার পৃষ্ঠপােষক ছিলেন তিনি। সমাজ প্রগতির আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন।

রামকানাই দত্ত (১৮৫২-১৯২০) : সমাজসেবক ও আইনজীবী রামকানাই দত্তের জন্ম ১৮৫২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুর গ্রামে। তিনি ছিলেন রাজা রামমােহন রায়ের অনুরাগী এবং ব্রাহ্মধর্মের অনুসারী। তিনি লােকনাথ দিঘি সংলগ্ন স্থানে একটি ব্রাহ্মমন্দির প্রতিষ্ঠাতা করেন। ১৯০১ সালে তিনি এডওয়ার্ড ইন্সস্টিটিউট (বর্তমান রামকানাই হাই একাডেমী) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ভাবসংগীত’ ‘অভিষেক গাঁথা ‘জীবনগীতিকা’ ‘অলকা ভবন’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করেন । ১৯২০ সালে রামকানাই দত্ত পরলােকগমন করেন ।

মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য্য (১৮৫৮-১৯৪৩) : দানবীর মহেশচন্দ্র ভট্টাচার্য ১৮৫৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার বিটঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ঈশ্বরচন্দ্র ভট্টাচার্য । একজন সমাজ সেবক ও শিক্ষানুরাগী হিসেবে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি কুমিল্লায় ঈশ্বর পাঠশালা হাইস্কুল, রামমালা ছাত্রবাস ও পাঠাগার, নিবেদিতা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা করেন । মহেশ ভট্টাচার্যের অর্থানকল্যে নবীনগরে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়েছে। চট্টগ্রামের সীতাকণ্ডে তিনি। গিরিশ ধর্মশালা, ভারতের কাশিতে হরসুন্দরী ধর্মশালা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-নবীনগরের মধ্যে ১৫ কি.মি. মহেশ রােড, কসবা বিজনা নদীর ওপর লােহারপুল এবং কুমিল্লায় একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করেন। দানবীর মহেশচন্দ। ভট্টাচার্য এ অঞ্চলে শিক্ষা বিস্তার ও সমাজ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা (১৮৬২-১৯২২) : নওয়াব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে নাসিরনগর থানার গােকর্ণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘ল’ পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। এ সময় তিনি রাজনীতিতে বিশেষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বাংলা গভর্নরের শাসন পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভায় প্রথম বাঙালি প্রেসিডেন্ট ছিলেন 

১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলাে নির্বাচিত হন। পরবর্তীকালে তাকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাকুর আইন অধ্যাপক নিযুক্ত করা। হয়। অধ্যাপনার সময় দণ্ডবিধি আইন সম্পর্কে তিনি যেসব বক্তৃতা দেন সেগুলাে। পরবর্তীকালে ব্রিটিশ ভারতীয় দণ্ডবিধি আইন’ নামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত।

১৯২১ সনে শামসুল হুদা সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন বঙ্গীয় প্রেসিডেন্সির গভর্নর লর্ড রােনাল্ডসে শামসুল হুদাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয় এর একজন ছিলেন তিনি এবং অন্য দু’জন ছিলেন ইংরেজ।

মুন্সি আব্দুল কাদির (১৮৬৬-১৯৬২): মুন্সি আব্দুল কাদিরের জন্ম ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইলে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পূর্ববঙ্গে মুসলিম পুনর্জাগরণ শুরু হলে। তৎকালীন মুসলিম নেতৃবৃন্দ পূর্ববঙ্গের অনগ্রসর মুসলিম জনসাধারণের স্বার্থরক্ষায় রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু করেন। মুন্সি আবদুল কাদির ছিলেন এই আন্দোলনের সমর্থক। ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলে তিনি তার সাথে সম্পৃক্ত হন। ঐ সময়ে তিনি সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ, জামেয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া ঈদগাহ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।

অখিল চন্দ্র দত্ত (১৮৬৯-১৯৫০) : অখিলচন্দ্র দত্ত ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে কসবার চারগাছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশবিরােধী অসহযােগ আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন। করেন। আইন অমান্য আন্দোলন, বিদেশি পণ্য বর্জন এবং বিপ্লবী প্রতিষ্ঠান অভয়আশ্রম প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। ভারতের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগ পর্যন্ত অখিলচন্দ্র দত্তের সক্রিয় ছিলেন । ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশের সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আইন সভার নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচিত হন। এই সংগ্রামী জননেতা ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল (১৮৭৪-১৯১৭) : ব্যারিস্টার আব্দুল রসুল নাসিরনগরের গুনিয়াউকের জমিদার গােলাম রসুলের পুত্র। তিনি ১০ এপ্রিল ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ। করেন। ১৪ বছর বয়সে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে যান। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে বি.এ. এবং ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে এম.এ পাশ করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের ইনারটেঙ্গল থেকে বি. সি. এল ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরেন। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন এবং কংগ্রেসের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যােগ দেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতের ভাইসরয়। লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের কথা ঘােষণা করলে, বঙ্গ-ভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় । তিনি ছিলেন বঙ্গ-ভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের সর্বভারতীয় প্রথম সারির নেতাদের একজন। ব্যারিস্টার এ রসুল কংগ্রেসের বিশিষ্ট নেতা ছিলেন এবং দেশের স্বাধিকারের জন্য হিন্দুমুসলমান সকলের মিলিত আন্দোলনে পক্ষপাতি ছিলেন। কংগ্রেসে থেকেও তিনি মুসলিম স্বার্থের প্রতি সজাগ ছিলেন যার প্রতিফলন স্বরূপ ‘দি মুসলমান’ নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। এ পত্রিকার মাধ্যমে তিনি মুসলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরার। প্রয়াস নেন। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ হিন্দু-মুসলমান সমঝােতার আগ্রহের পরিচয় বহন করে। ১৯১৭সালে কলকাতার নিজ বাসভবনে তিনি পরলােকগমন করেন। তার স্মরণে কলকাতার এলবার্ট হলে এক স্মরণ সভার আয়ােজন করা হয়, ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন মহাত্মা গান্ধী।

মাওলানা রুকন উদ্দিন : মাওলানা রুকন উদ্দিনের জন্য মেরাসানি গ্রামে। মুসলিম জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের একজন কৃতী পুরুষ ছিলেন। মাওলানা রুকন উদ্দিন আহমেদ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এম. এল এ ছিলেন। মেরাসানিতে তাঁর প্রতিষ্ঠিত পলিটেকনিক স্কুলটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রথম কারিগরি স্কুল।

বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত (১৮৮৫-১৯৬৫) : বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ এপ্রিল কালিকচ্ছের বাঘবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ডকার্জন বঙ্গ ভঙ্গের ঘােষণা দিলে অবিভক্ত বাংলাসহ ভারতব্যাপী আন্দোলন গড়ে ওঠে। উল্লাসকর দত্ত এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিলেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ মে তিনি পরলােকগমন করেন।

বিপ্লবী সুনীতি চৌধুরী : ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনে যে দু’জন মহিলা | ভারতে নারী সমাজের মুখ উজ্জ্বল করেছিলেন তাঁরা হলেন, শান্তিঘােষ ও সুনীতি চৌধুরী। এই দুই অগ্নিকন্যা ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ডিসেম্বর কুমিল্লার ইংরেজ জেলা | ম্যাজিস্ট্রেট মি. স্টিভেন্সকে তার অফিসে পিস্তলের গুলিতে হত্যা করে। সমগ্র ভারত | উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এই দু’মেয়ে ইংরেজ হত্যা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। সুনীতি চৌধুরীর জন্মস্থান নবীনগরের ইব্রাহিমপুরে। তাঁর পিতা উমাচরণ চৌধুরী কুমিল্লায় | সরকারি চাকরি করতেন। তার মাতার নাম সুরসুন্দরী দেবী।

ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (১৮৮৬-১৯৭১) : ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার রামরাইলে ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কিছু কাল শিক্ষকতার পর আইন ব্যবসায় আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরােধিতার মাধ্যমে তার রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। তার রাজনৈতিক গুরু ছিলেন ব্যারিস্টার আবদুল রসুল । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের সক্রিয় কর্মী। বহরমপুরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি কংগ্রেসের জন্যে অর্থ সংগ্রহের নিমিত্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রত্যন্ত এলাকার ব্যাপক তৎপরতা চালান। আইন অমান্য আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি ১৯৩০ সালে কারাবরণ করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পুনরায় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে গঠিত মন্ত্রিসভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ২৯ মার্চ রাতে পাকবাহিনী তাকে কুমিল্লার বাসভবন থেকে ধরে নিয়ে যায়। এবং পাকবাহিনীর হাতে তিনি পরবর্তীকালে নিহত হন।

খান সাহেব আনছর আলী (১৮৮৭-১৯২৮) : খান সাহেব আনছর আলী মােক্তারের জন্ম ১৮৮৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পশ্চিম মেড্ডায়। তিনি পৌরসভার কমিশনার ও ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে ২০ বছর দায়িত্ব পালন করেন। জনহিতকর কাজে তার খ্যাতি ছিল। ১৯০৯ সাল থেকে পাক্ষিক প্রজাবন্ধু (পূর্ণচন্দ্র চক্রবর্তী সম্পাদিত) প্রকাশে সহায়তা করেন। তিনি ছিলেন সেন্ট্রাল কো-অপারেটিভ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তিনি পরলােকগমন করেন।

নবাব স্যার কে.জি.এম ফারুকী (১৮৯০-১৯৮৪) : নবাব স্যার কে.জি.এম ফারুকী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার রতনপুর গ্রামে ১৮৯০ সালে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি অবিভক্ত বাংলার শিক্ষা, শিল্প, কৃষি ও স্বাস্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ১৯৩৪ সালে তৎকালীন জর্জ হাইস্কুল (বর্তমান নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়) পরিদর্শনে আসেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকল্পে আর্থিক অনুদান মঞ্জুর করেন। তিনি ১৯২২ সালে খান বাহাদুর’ ১৯৩৪ সালে ‘নবাব’ ১৯৩৬ সালে নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন। স্ত্রী শিক্ষার উন্নতিকল্পে কলকাতায় ত্রিপুরা হিতসাধিনী সভার জন্ম। হয়েছিল। তিনি ছিলেন তার সভাপতি। ১৯৮৪ সালে ২৪ এপ্রিল তিনি কলকাতার নিজ বাসভবনে পরলােক গমন করেন।

খান বাহাদুর ফরিদ আহাম্মদ (১৮৯২-১৯৭৬) : খান বাহাদুর ফরিদ উদ্দিন আহাম্মদ-এর জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ পৈরতলার সৈয়দ বাড়িতে। তাঁর কর্মজীবনের শুরু কুমিল্লা জজকোর্টে আইনে পেশার মাধ্যমে। গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে তিনি কুমিল্লা জেলা বাের্ডের ভাইস চেয়ারম্যান ও চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বঙ্গীয় পষিদের এম. এল. এ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

বিপ্লবী অতীন্দ্র মােহন রায় (১৮৯৪-১৯৭৯) : নবীনগর থানার ভােলাচঙয়ের আনন্দমােহন রায়ের পুত্র অতীন্দ্রমােহন রায় কুমিল্লা ইউসুফ স্কুলে অধ্যয়নকালে ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনে যােগদেন। অতীন্দ্র রায় বিপ্লবী গুপ্ত সংগঠন অনুশীলন দলের সদস্য ছিলেন। তার জীবনের ২৫ বছর কেটেছে কারাগারে, ১৪ মাস আত্মগােপন করে ও ৩৫ দিন অনশনে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে গঠিত বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। তিনি নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর ঘনিষ্ট সহযােগী ছিলেন। দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭-১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত অতীন্দ্ররায় কুমিল্লা পৌর সভার চেয়ারম্যান ছিলেন। অভয়-আশ্রমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে ছিল তার নিয়মিত যােগাযােগ। ১৯৬৯ সালে গঠিত শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের তিনি ছিলেন। অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে ছিল তাঁর গ্রহণযােগ্যতা। তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।

খান বাহাদুর শহীদুল হক (১৮৯৪-১৯৬৮) : ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে খান বাহাদুর শহীদুল হক ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার চাওড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সিঙ্গারবিল ইউনিয়ন বাের্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে সেবায় আত্মনিয়ােগ করেন এবং কর্মকুশলতায় পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া লােকালবাের্ড ত্রিপুরা জেলা বাের্ডের সক্রিয় সদস্য হন। পাকিস্তান আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগে যােগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি পাকিস্তান কন্সটিটিওয়েন্ট এসেম্বলির সদস্য হন এরং পার্লামেন্টারি দেলিগেশনের সদস্য হিসেবে ইংল্যান্ড ও ইউরােপের বিভিন্নদেশে সফর করেন। খান বাহাদুর শহীদুল হক নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন।

কৃষক নেতা আব্দুল মালেক (১৮৯৮-১৯৬৫) : ১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে কসবা থানার গােপীনাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষি প্রধান বাংলার কৃষকরা ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা শােষিত ও বঞ্চিত হতে থাকে। ব্রিটিশবিরােধী কৃষক আন্দোলনের শুরু থেকেই বিশিষ্ট কংগ্রেসকর্মী আব্দুল মালেকের কৃষকদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ পায়। তার। ঐতিহাসিক স্লোগান ‘লাঙ্গল যার জমিন তার স্বপক্ষে তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেন । তাঁর কর্মকাণ্ডকে শুধু রাজপথে সীমিত না রেখে তিনি সুশীল সমাজের সামনে লেখনির মাধ্যেমেও কৃষককূলের দুঃখ-দুর্দশা তুলে ধরেন। ১৯৪৬ সালে তিনি নিখিল বঙ্গ কৃষকপ্রজা সমিতির যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি সুভাষ বসুর অন্তরঙ্গ অনুরাগী এবং বাংলার দ্বিধাবিভক্ত কংগ্রেসের ফরওয়ার্ড ব্লকের সদস্য ছিলেন। দেশের অভ্যন্তরে আজাদ হিন্দ বাহিনির গুপ্তচর হিসেবে বাড়িতে ছাতির কারখানার আড়ালে তিনি বিপ্লবী প্রচারণা ও সৈন্য সংগ্রহের প্রচেষ্টা চালান। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে তিনি ১৬ বছর কারাবরণ করেন ও তিন দফায় নয় বছর আত্মগােপন করে নিরুদ্দেশ ছিলেন। তিনি ১৯৬৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

নিত্যানন্দ পাল : নিত্যানন্দ পাল ওরফে নিতাইপাল ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মধ্যপাড়ার অধিবাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন শিক্ষানুরাগী ও দানশীল ব্যক্তি। ১৯৬৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠাকালে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আনন্দময়ী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় এবং কালীবাড়ির ভুবনমহল মন্দির প্রতিষ্ঠায় তার অবদান রয়েছে ।

অনুদাচরণ রায় : অন্নদাচরণ রায়ের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্ভান্ত এক জমিদার পরিবারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিক্ষা ও সামাজিক সংস্কারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় এবং সরাইল অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।

হাবিবুর রহমান চৌধুরী (১৮৯৯-১৯৭২) : ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বিশিষ্ট কংগ্রেস নেতা হাবিবুর রহমান চৌধুরী-১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে কসবা থানার গােপীনাথপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩০ সালে মহাত্মা গান্ধী লবণ আইন আন্দোলনের সূত্রপাত করলে হাবিবুর রহমান চৌধুরী সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩২ সালে তিনি আইন অমান্য আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে কিছুদিন কারা নির্যাতন ভােগ করেন। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্বে দিতে গিয়ে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৮ আগস্ট পুনরায় গ্রেফতার হয়ে ১৪ মাস কারাগারে বন্দি থাকেন। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের তিন সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টারি বাের্ডে সদস্য ছিলেন। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাঁকে সেখানকার ওয়াকফ কমিশনার নিযুক্ত করলে ঐ পদে তিনি ১১ বছর কাজ করেন। ১৯৬৩ সালে কলকাতা থেকে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে তিনি পরলােক গমন করেন।

মৌলভী জিল্লুর রহমান (১৯০৯-১৯৯৪) : মৌলভী জিল্লুর রহমানের জন্য ১১, খ্রিস্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কাজীপাড়ায়। ছাত্রজীবনেই সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলনের জড়িত হয়ে তিনি অবিভক্ত বাংলার মুসলিম লীগে যােগদান করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে ব্রিটিশবিরােধী স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রসরকর্মী। সেইসময়ে রাজনৈতিক কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি তৎকালীন বাংলার অবিসংবাদিত জননেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্ক রক্ষা করতেন। তারা দুজনই রাজনৈতিক সফরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলে মৌলভী জিল্লুর রহমানের গৃহে অবস্থান করতেন। মৌলভী জিল্লুর রহমান একাধারে একজন সমাজসেবক ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তিনি ১৯৯৪ সালের ২৯ মে পরলােক গমন করেন।

এ.কে.এম জহিরুল হক (লিল মিয়া) (১৯০৩-১৯৮১) : জহিরুল হক লিল মিয়া বাঞ্ছারামপুর থানার দড়িকান্দি গ্রামে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত তিনি কংগ্রেসে ছিলেন । ১৯৩৭ সালে তিনি মুসলিমলীগে যােগ দেন। তিনি জেলা মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন ১৯৪০ পর্যন্ত। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি আওয়ামী মুসলিমলীগে যােগ দেন। ১৯৫৪ এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে তিনি আইন সভার সদস্য হন এবং ১৯৫৫-৫৭ দু’বছরের মন্ত্রিসভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

এ.কে রফিকুল হােসেন (১৯২০-১৯৭৯) : এ.কে রফিকুল হােসেন নবীনগর থানার থানাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি (কলকাতাকেন্দ্রিক) নিখিল বঙ্গ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। মওলানা ভাসানী যখন মুসলিম লীগের বিকল্প আওয়ামীলীগ গঠন করেন তখন তিনি ছিলেন এর যুগ্ম-সম্পাদক। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৬ এর ৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নে তার বিশেষ ভূমিকা ছিল। তিনি ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দে ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন।

মাে. আবদুল হাই (১৯০৫-১৯৯২) : মাে. আবদুল হাই ১৯০৫ সালে ৩১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ঘাটিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সরকারি চাকুরিজীবী হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু হয়। অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৬২ সালে এবং ১৯৬৫ সালে দু’বার স্বতন্ত্রপ্রার্থী হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি শিক্ষা ও সমাজসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত ছিলেন।

এন আই ভূঁইয়া (১৯০৬-১৯৬৬) : খ্যাতিমান রাজনৈতিক ও সমাজসেবক এন আই ভূইয়া ১৯০৬ সালে কসবা উপজেলার চারগাছ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। এন. আই ভূঁইয়া অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৬৬ সালের ১৩ মে তিনি পরলোক গমন করেন 

ড. মমতাজ উদ্দিন আহমেদ (১৯০৩-১৯৭১) : উপমহাদেশের প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ মমতাজউদ্দিন আহমেদ ১৯০৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার বড়হরণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মৌলভী রুসমত আলী কৃারি ১৯১৮ সালে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইলে বসতি স্থাপন করেন । ডক্টর মমতাজউদ্দিন আহমেদ ১৯১৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জর্জ স্কুল (বর্তমানে নিয়াজ মুহম্মদ হাই স্কুল) থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রথম বিভাগে মেধা তালিকায় স্থানসহ এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯২৬ সালে স্বর্ণপদকসহ প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে এম.এ পাশ করেন। তিনি ১৯৩৭ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনের মেটাফিজিক্স এবং লজিক-এর উপর পি. এইচ. ডি ডিগ্রি লাভ করেন।

তিনি ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৩৯-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের প্রথম মুসলমান প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । ১৯৪৫-১৯৫০সাল পর্যন্ত রাজশাহী কলেজের প্রথম বাঙালি প্রিন্সিপাল ছিলেন। ১৯৫২-১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ডিপিআই (ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইন্সট্রাকশন) হিসেবে এ দেশের শিক্ষাবিভাগে নিয়ােজিত ছিলেন। ১৯৫৬-৫৭ সালে তিনি পাকিস্তান সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ও প্রথম বাঙালি হিসেবে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে যােগদান করেন। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে কৃতিত্বের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। নব-প্রতিষ্ঠিত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তার সময়ে একটি আধুনিক পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়। তিনি UNESCO একজিকিউটিভ বাের্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তা ছাড়া তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট এবং ইসলামাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য ছিলেন।।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৫ সালে অবসর গ্রহণের পর তিনি বাংলা উন্নয়ন বাের্ডের মেম্বার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এই মহান শিক্ষাবিদ বার্ধক্যজনিত কারণে ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকায় পিজি হাসপাতালে শেষ নিঃশাস ত্যাগ করেন।

অধ্যক্ষ মােহাম্মদ শামসুল হুদা (১৯১৭-১৯৯৬) : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ লেখক, অধ্যক্ষ শামসুল হুদা ১৯১৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানার ঘাটিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মাওলানা আবদুল মজিদ ছিলেন একজন ফাজেল মাদ্রাসা শিক্ষক। শামসুল হুদা কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে ফাজেল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ১৯৪৫ সালে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে তিনি শিক্ষকতাকে বেছে নেন। তিনি কিশােরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে অধ্যাপক, উপাধ্যক্ষ এবং অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন । তিনি ছিলেন একজন সু-লেখক। তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ হচ্ছে, ‘পলাশী উত্তর বাংলার আর্থ-সামাজিক অবস্থা’, ‘নারীর অধিকার ও মর্যাদা’, ‘মহানবীর জীবন ও আদর্শ’, ‘বাংলার মুসলমানদের উৎপত্তি ও তাদের আদি ইতিহাস এবং ‘বঙ্গভঙ্গ ও লর্ড কার্জন’ । অসামান্য পান্ডিত্যের অধিকারী অধ্যক্ষ শামসুল হুদা তার রচিত গ্রন্থগুলােতে মননশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। ইসলামে নারীর অধিকার ও  মর্যাদা এবং ‘মহানবীর জীবন ও আদর্শ গ্রন্থের জন্য তিনি সবমহলে প্রশংসিত ‘ হয়েছেন। ১৯৯৬ সালে এই গুণিলেখক ও শিক্ষাবিদ পরলােকগমন করেন।

প্রফেসর মুহাম্মদ নােমান (১৯২৪-১৯৯৬) : প্রফেসর মুহাম্মদ নােমানের জন্য।১৯২৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুর থানার উলুকান্দি গ্রামে। তিনি ছিলেন অনুদা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র এবং শৈশবেই তার প্রতিভার স্ফুরণ ঘটে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য এম. এ পাশ করেন। খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ নােমান ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য ও রেজিস্টারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পরলােক গমন করেন ।

ডক্টর এস,এ, কাদির (১৯৩১-১৯৮৬) : বিশিষ্ট সমাজতাত্ত্বিক গবেষক ড. সৈয়দ | আবদুল কাদির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক অনন্য কৃতী সন্তান। ১৯৩১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার পেয়ারাকান্দি গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিসংখ্যান বিষয়ে সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রামীণ সমাজতত্ত্বে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কুমিল্লায় বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমী এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ইন্সটিটিউট-এর অধ্যক্ষ ছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ডক্টর এস এ কাদির বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের গবেষণা পরিচালক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ১৯৮৬ সালের ৭ অক্টোবর ইন্তেকাল করেন।

শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুনাম উপমহাদেশখ্যাত । সাহিত্যসংস্কৃতিতে যেমন, ইতিহাস-ঐতিহ্যের ক্ষেত্রেও তেমনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশেষ অবদান রয়েছে। এমনি একটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য বিষয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লােক-সাহিত্য বা লােকজ-সংস্কৃতি। এখানকার লােকজ সাহিত্য ও সংস্কৃতির ঐতিহ্য অত্যন্ত উন্নত ও সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এখানকার সাহিত্যসংস্কৃতির মূল কাঠামাে। প্রকৃতপক্ষে যে দেশ বা সমাজের লােক-সাহিত্য যত উন্নত সে দেশ বা সমাজের আধুনিক সাহিত্যও তত সমৃদ্ধ। এই সমৃদ্ধ সাহিত্য সাধকদের মধ্যে থেকে কয়েকজনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এখানে উল্লেখ করা হলাে।

মিরজা হােসেন আলী : লােকধারার এক মহান মাধক কবি মিরজা হােসেন আলী রামপ্রসাদের সমসমায়িককালে সাহিত্যসাধনা করে তিনি খ্যাতি লাভ করেছিলেন। অনেক গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে তাঁর সাহিত্য প্রসঙ্গ আলােচিত হয়েছে। অনাথকৃষ্ণ দেব প্রণীত “বঙ্গের কবিতা’ (১৩১৮) গ্রন্থে তার লেখার উদ্ধৃতি রয়েছে। ১৩২০ সালে মুন্সি আব্দুল করিম সাহিত্য বিশারদের বাংলা প্রাচীন পুথির বিবরণ’ সংকলনেও মিরজা হােসেন আলীর গানের উদ্ধৃতি লক্ষণীয়। তার গানে ভক্তিভাব ও অধ্যাত্ম প্রেমের প্রাধান্য লক্ষণীয় । মিরজা আলী নবীনগর উপজেলার শ্যামগ্রামে জন্ম গ্রহন করেন ।

বানচন্দ্র তর্কালঙ্কার : সাধক কবি বানচন্দ্র তর্কালঙ্কার শাস্ত্রীয় সাধনায় ছিলেন সিদ্ধ। তিনি একাধারে শক্তিমন্ত্রের গুরু, সংগীত রচয়িতা ও কবি ছিলেন। যতটুকু জানা যায়, কবি মিরজা হােসেন আলী ছিলেন তারই ভাবশিষ্য। বানচন্দ্র তর্কালঙ্কার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাদুঘর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

মুন্সি ছমির উদ্দিন : মুন্সি ছমির উদ্দিন ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ফার্সিভাষা চর্চার ঐতিহ্যগত ধারায় মুন্সি ছমির উদ্দিন খ্যাতি লাভ করেন। তিনি ছিলেন এক মরমি ফার্সি কবি । ফার্সিভাষা, চর্চার জন্যে তিনি সুদূর পারস্যে গিয়েছিলেন। ফার্সি ভাষায় তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘গুলবানে আখতার’ ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯০৮ সালে মুন্সি ছমির উদ্দিন ইন্তেকাল করেন।

আজুদ্দীন মুহম্মদ আজুদ : জন্ম ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে সরাইল থানার শাহবাজপুর গ্রামে। তিনিও ফার্সি ভাষায় সাহিত্যচর্চা করেন। তাঁর গ্রন্থ ‘আরুয আল কাওয়াদী’ ও ‘ইয়াদগারে আজদাদ’। ধর্মীয় আধ্যাত্মিকতায় তাঁর সাহিত্যের সাফল্য প্রশংসনীয়।

সৈয়দ রিয়াতুল্লাহ : সৈয়দ রিয়াতুল্লাহ নাসিরনগরের গােকর্ণ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নবাব স্যার সৈয়দ শামসুল হুদা কে, সি, আই, ই তাঁরই সুযােগ্য সন্তান। তিনি আরী-ফার্সী ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ফার্সী ভাষার সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।

দেওয়ান রামদুলাল নন্দী : কবি দেওয়ান রামদুলাল নন্দী সরাইলের কালীকচ্ছ গ্রামে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তিনিও মূলত একজন কবি। তাঁর দেহতত্ত্ব বিষয়ক সংগীতের কথা বিভিন্ন ভাবে প্রশংসিত হয়েছে ।

কৈলাসচন্দ্র সিংহ : ‘রাজমালা’ উপাখ্যানের গদ্য রূপান্তরের জন্য তিনি বিশেষভাবে খ্যাত হন। তাছাড়া তিনি ‘কাঙ্গালের গীত’ ও ‘কাঙ্গারের গীতা’ গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন। তার জন্ম ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে সরাইলের কালীকচ্ছ গ্রামে। | মহির্ষি মনােমােহন দত্ত : ‘মলআ বা সদ্ভাব সংগীত গ্রন্থের রচয়িতা মনােমােহন দত্ত ১২৮৪ বঙ্গাব্দে নবীনগর উপজেলার সাতমােড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার সাহিত্যে মানবকল্যণ এবং ধর্মীয় সম্প্রীতির কথা উচ্চস্বরে উদ্ভাসিত। তিনি সর্বধর্মে সমন্বয় এবং একেশ্বরবাদী ধারণাকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।

পণ্ডিত শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার : পণ্ডিত শশিভূষণ বিদ্যালঙ্কার এর জন্মস্থান নবীনগর থানার বিদ্যাকুট গ্রামে। তার অমর কীর্তি ‘জীবনী কোষ’ গ্রন্থ। তিনি ১৯৩৪-৪৪ সালের মধ্যে এই বৃহৎ জীবনী কোষ পৌরানিক ও ঐতিহাসিক এই দুই অংশে বিভক্ত। পৌরাণিক অংশ দুই খণ্ডে (২২০০ পৃষ্ঠা) এবং ঐতিহাসিক অংশ পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি বাল্যসখা’ ও ‘স্বাবলম্বন’ নামে দু’টি পত্রিকাও সম্পাদনা করতেন। তার স্ত্রী বনলতা দেবী কলকাতা থেকে প্রকাশিত ‘অন্তঃপুর’ পত্রিকার সম্পাদিকা ছিলেন। তাঁদের কৃতী সন্তান অধ্যাপক দেব্রত সাহিত্যের বঙ্গানুবাদ করেছেন।

শশিভূষণ চক্রবর্তী : শশিভূষণ চক্রবর্তী ১৯০৫ সালে নবীনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহী ইব্রাহিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইন্ডিয়ান গেজেটিয়ার’-এর। সম্পাদক ছিলেন। তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ্যযােগ্য হচ্ছে ‘এথনিক সেটেলমেন্ট ইন এনশিয়েন্ট ইন্ডিয়া’, ‘সিভিল রিবেলিয়ন ইন দি ইন্ডিয়ান মিউথিনিক’ গ্রন্থ দু’টি।

গুরুচরণ চক্রবর্তী : দার্শনিক গুরুচরণ চক্রবর্তী সরাইলের চুন্টা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্থানুশ্রী’ নামক দার্শনিক গ্রন্থ ১২ খণ্ডে রচিত। তিনি ১৮৯০ থেকে ১৯০ সালের মধ্যে এই ১২ খণ্ড গ্রন্থ রচনা করেন। অবিভক্ত বাংলায় এই গ্রন্থ লিখে প্রচুর সুনাম অর্জন করেছিলেন।

হরিশ্চন্দ্র সেন : কবি হরিশ্চন্দ্র সেন সরাইল উপজেলার প্রসিদ্ধ চুন্টা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘মূখের প্রায়শ’ ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়।

আব্দুল লতিফ খান : প্রখ্যাত লেখক শিক্ষাবিদ আবদুল লতিফ খান সদর থানার ঘাটুরা গ্রামে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। ইংরেজি ভাষায় মূল্যবান গ্রন্থ লিখে তিনি ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তাঁর এ শর্ট হিস্ট্রি অব গেস্নারিয়াস মুসলিম। সিভিলাইজেশন’, এ শর্ট জিওগ্রাফি অব ইউরােপ, এশিয়া, আফ্রিকা, এমেরিকা অ্যান্ড ওশেনিয়া’, ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়া’, ‘হােলি কোরআন অ্যান্ড দি ওয়ার্ল্ড সিভিলাইজেশন’ এবং ভারতের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রভৃতি গ্রন্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ রচনা ।১৯৫৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এই মহামনীষী ও শিক্ষাবিদ ইন্তেকাল করেন।

প্রবােধচন্দ্র সেন : ছান্দাসিক প্রবােধচন্দ্র সেনের জন্ম ১৮৯৭ সালে সরাইল থানার চুন্টা গ্রামে। তিনি শান্তিনিকেতনে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি বাংলা ছন্দ বিষয়ে গবেষণায় অসামান্য অবদান রাখেন। তাঁর উল্লেখ্যযােগ্য গ্রন্থ ‘বাংলা ছন্দে রবীন্দ্রনাথের দান’ (১৯৪৫), ছন্দ পরিক্রমা’ (১৯৬৫) জিজ্ঞাসা’ (১৯৭৪) ‘বাংলা ছন্দসমীক্ষা’ (১৯৭৭) প্রভৃত্তি। শিক্ষাবিদ, ছান্দসিক প্রবােধচন্দ্র সেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গৌরব।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ : প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ১৯১৪ সালের ১ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার গােকর্ণঘাট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর রচিত “তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিশেষ মর্যাদার আসন লাভ করেছে। উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। এতে তিতাস পাড়ের জনজীবনের কাহিনি যেমন ফুটে উঠেছে তেমনি লােকজ আচার অনুষ্ঠানও বিধৃত হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লােকজ সংস্কৃতির প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই উপন্যাস। তিনি বেশ কিছু লােকসংগীতও সংগ্রহ করছেন। তাঁর রচিত গ্রন্থমালার মধ্যে ‘জীবন তৃষা’ ‘তিতাস একটি নদীর নাম ‘রাঙামাটি শাদা হাওয়া’ প্রভৃতি উলেখযােগ্য। এছাড়া তিনি বেশকিছু কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ-নিবন্ধন, আলােচনা-সমালােচনা লিখেছেন। ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল তিনি কলকাতায় লােকান্তরিত হন।

সূফী জুলফিকার হায়দার : সূফী জুলফিকার হায়দারের জন্ম ১৯৯৯ সালের ৩ জুন। জন্মস্থান নবীনগর উপজেলার ভাতুরিয়া গ্রামে। বহু সংখ্যক গ্রন্থের তিন প্র তার কাব্যগ্রন্থ গুলাে হচ্ছে ‘ভাঙ্গা তলােয়ার’ (১৯৪৫), ফাতেহ-ই-দোয়া (১৯৪৭), স্বপ্ন যার, আনল যে, গড়লাে যারা, (১৯৫৯), “সামনে কদম (১৯৬০), ‘জেহাদের আহবান’ (১৯৬৫), সিপাহী’ (১৯৭৮)। সূফী সু” হায়দারের বিখ্যাত স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘নজরুল জীবনের শেষ অধ্যায় -‘বিদ্রোহী নজরুল নীরব আজি’ (১৯৬৫) এবং নজরুল বিষয়ক অনন্য সংকলন ‘নজরুল। প্রতিভা পরিচয়’ (১৯৮৪), তাছাড়া ‘শত বেদনা সয়েছি নীরবে’ (১৯৭০) নামে তার গুরুত্বপূর্ণ একটি ভ্রমণকাহিনীও রয়েছে। সূফী জুলফিকার হায়দার ১৯৮৭ সালের ২৩ এপ্রিল ঢাকায় পরলােকগমন করেন ।

মিজানুর রহমান : খ্যাতিমান লেখক মিজানুর রহমানের জন্ম ১৯০০ সালের ১ ডিসেম্বর বাঞ্ছারামপুর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নবীনগরে। পেশাগত জীবনে তিনি। ছিলেন একজন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা। সরকারি চাকরির পাশাপাশি তিনি লেখক হিসেবেও ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। পথের পয়গাম’, ‘জাগরণী’, ‘পান্দেনামা, শিকওয়া ও জবাব’, ‘নূরের ঝলক’, ‘বেহেস্তি সওগাত’, ‘জিন্দা মুসলমান, নজরুল ইসলাম’, ‘নজরুল ইসলামরে কতিপয় গজল’, ‘লাইফ এন্ড লাইট, এবং “দি মেমােয়ার্স অব ভি আই পি’ প্রভৃতি গন্থে তাঁর সাহিত্য খ্যাতির পরিচয় মেলে।

চৌধুরী শামসুর রহমান : ছােটগল্প, উপন্যাস ও জীবনী লেখক হিসেবে চৌধুরী শামসুর রহমান খ্যাতি অর্জন করেন। মস্তানগর’, ‘পঁচিশ বছর’, শেষ পর্বে শ্রীকান্ত প্রভৃতি উপন্যাস উল্লেখযােগ্য। তিনি কিছু গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ অনুবাদও করেন। চৌধুরী শামসুর রহমান ১৯০২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চম্পকনগরে জন্মগ্রহণ করেন।

কবি আবদুল কাদির : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক কবি আবদুল কাদির ১৯০৬ সালের ১ জুন আশুগঞ্জের আড়াইসিধা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । ছাত্রজীবনে তাঁর সাহিত্য চর্চার হাতেখড়ি ঘটে। রবীন্দ্রযুগেই তিনি বাংলা সাহিত্যের মূলধারায় স্থান করে নিতে সক্ষম হন। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আব্দুল কাদির কবি, গবেষক, সম্পাদক ও ছান্দসিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর ‘দিলরুবা’ (১৯৩২) এবং ‘উত্তরবসন্ত’ (১৯৬৭) দু’টি গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। বাংলাছন্দ বিষয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা এবং ছন্দ বিশেস্নষণমূলক গ্রন্থ ‘ছন্দ সমীক্ষণ’ (১৯৬৭) তাঁকে ছান্দসিক হিসেবে পরিচিত করে তােলে। কিন্তু আব্দুল কাদির আরাে বেশি খ্যাতি অর্জন করেন তার দায়িত্বশীল পত্রিকা সম্পাদনা এবং গবেষণা কাজের জন্য। ১৯২৭ সালে একাশিত ‘শিখা পত্রিকা মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীদের এক প্ল্যাটফর্মে সমেবেত করে। তাছাড়া ‘নবশক্তি’, ‘যুগান্তর’, ‘নবযুগ’, মােহাম্মদী’, ‘পয়গাম’, এবং মাহে নও’, সম্পাদনার কাজেও তিনি কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৬৩ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ১৯৭৫ সালে কুমিল্লা ফাউন্ডেশন স্বর্ণ পদক লাভ করেন। ১৯৮৪ সালের ১৯ ডিসেম্বর কবি আবদুল কাদির ঢাকায় পরলােকগমন করেন।

সঞ্জয় ভট্টাচার্য : খ্যাতিমান লেখক সঞ্জয় ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯০৯ সালে নবীনগর উপজেলার শ্যামগ্রামে। এককালে তার বৃত্ত’ উপন্যান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছিল। বৃত্ত ছাড়াও ‘সৃষ্টি’, ‘নতুন দিনের কাহিনী এবং “তিন জন আধুনিক কবি তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। তাছাড়া সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘সাগর’ নামে একটি কবিতার বই রয়েছে। ১৯৬৯ সালে। তার দেহবসান ঘটে।

আব্দুল হাফিজ : অনুবাদক আব্দুল হাফিজের জন্ম ১৯০৮ (মতান্তরে-১৯১১) সালে নবীনগর উপজেলার লক্ষ্মীপুর গ্রামে। বিশ্ব সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ লেখা অনুবাদ করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। অনুবাদের জন্য তিনি ১৯৭৮ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। অনুবাদ ছাড়াও তার কিছু ছােটগল্প স্মৃতিচারণমূলক রচনা রয়েছে। ১৯৯৪ সালে ৩০ অক্টোবর তিনি পরলােকগমন করেছেন ।

জমিলা বেগম : তার জন্ম ১৯১০ সালে নবীনগর উপজেলার গাঙ্গেরকুল গ্রামে। তাঁর কবিতায় ও সাহিত্যে যথেষ্ট মৌলিকত্ব রয়েছে। প্রকাশিত লেখার মধ্যে তাঁর উদার দৃষ্টিভঙ্গি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। সংশয় এবং “কালান্তরের ঢেউ” তার উল্লেখ্যযােগ্য রচনা । জমিলা বেগম তার সম্পাদনায় মাসিক ‘মা’ নামে একটি মাসিক মহিলা পত্রিকা প্রকাশ করেন। দীর্ঘদিন এটি মাসিক মহিলা সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী সময়ে এটি সাপ্তাহিক পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়। মমতাময়ী এই মহিয়সী কবি ২০০৪ সালের ৩০ মার্চ তার নিজস্ব বাসভবন ‘পলাশ বাড়ি’ স্টেশন রােড, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মৃত্যু বরণ করেন।

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী : বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর জন্ম ১৯১২ সালের ২০ আগস্ট সরাইল উপজেলার কালীকচ্ছ গ্রামে। তার খেলনা’, ‘শালিক কি চড়ই’, ‘বন্ধুপত্নী” প্রভৃতি ছােট গল্পগ্রন্থ এবং সূর্যমুখী’, ‘মীরার দুপুর’, ‘বার ঘর এক উঠান’ প্রভৃতি উপন্যাস উল্লেখযােগ্য।

ইমাউল হক : রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কবিতার ধারায় ইমাউল হক যথেষ্ট যােগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। ত্রিশের কবিদের মতই তিনি কবিতায় ইন্দ্রিয় ঘনত্বের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। ইমাউল হকের ‘অনুরাগ’ কাব্যগ্রন্থে প্রেম ও বিরহের আবহে প্রকৃতির ঘনিষ্ট বিন্যাস লক্ষ করা যায়। ইমাউল হকের জন্ম ১৯১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সদর উপজেলার চাউরা গ্রামে।

মতিউল ইসলাম : মতিউল ইসলামের জন্ম ১৯১৪ সালের ৫ নভেম্বর নাসিরনগর উপজেলার গুনিয়াউক গ্রামে। দুলালী’ (১৯৩৬), ফরিয়াদ (১৯৪৭), ‘মাটির কন্যা’ (১৯৪৮), ‘কায়েদ আজম তােমার জন্য (১৯৫০), ‘প্রিয় ও পৃথিবী (১৯৫৫), ‘সপ্তকন্যা’ (১৯৫৫), ‘পুষ্পবীথি’ (১৯৬২) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তার মৌলিক সাহিত্যকৃতি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৬ সালে কবিতার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

সানাউল হক : আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি সানাউল হক। জন্ম ১৯২৩ সালের ২৩ মে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার চাউরা গ্রামে। সনেট নির্মাণের দক্ষতায় বাংলা কাব্যজগতে তার অধিষ্ঠান। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থগুলাে হচ্ছে- ‘সম্ভাব্য অনন্যা’, ‘বিচুর্ণ আর্শি’ ‘একটি ইচ্ছে সহস্র পালে’, ‘পদ্মিনী শঙ্খিনী’, ‘কাল সমকাল’, ‘ইচ্ছা ব্যপ্তি আনন্দ’ প্রভৃতি। ১৯৬৪ সালে তিনি ইউনেস্কো পুরস্কার লাভ করেন।

আনিস চৌধুরী : শিশু সাহিত্যিক ও কথাশিল্পী আনিস চৌধুরীর জন্ম ১৯২৯ সালে কসবা উপজেলার গােপীনাথপুর গ্রামে। সখের পুতুল’, ‘সরােবর’, ‘সৌরভ’ ও ‘মধুগড় প্রভৃতি তার উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। তিনি একজন নাট্যকার হিসেবেও খ্যাতি লাভ করেন। নাট্য সাহিত্যের জন্য তিনি ১৯৮৬ সালে বাঙলা একাডেমী পুরস্কার লাভ করেন।

আবদুর রউফ মাহমুদ : জন্ম ১৯১৭ সালে আশুগঞ্জের বড়তল্লা গ্রামে। প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মধ্যদিনের সূর্য’ । অন্যান্য গ্রন্থ নয়াগাঁও’, ‘নয়াজিন্দেগী’, ‘অভিযান’ এবং ‘সংগ্রাম চলবেই’ প্রভৃতি। ১৯৫৪ সালে তিনি সাহিত্যরত্ন খেতাবে ভূষিত হন।

আহমেদুর রহমান : সাংবাদিক আহমেদুর রহমানের কৃতিত্ব শুধু সাংবাদিক হিসেবেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সাহিত্য অনুবাদ এবং সাহিত্য রচনায়ও তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। আহমেদুর রহমান রচনাবলী’ সে সাক্ষ্যই বহন করে। তাঁর জন্ম ১৯৩৪ সালে সরাইল উপজেলার উচালিয়াপাড়া গ্রামে।

মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ : আধুনিক বাংলা কবিতার মূলধারায় মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে। তিনি পঞ্চাশের দশকের অন্যতম কবি । ‘জুলেখার মন’ (১৯৫৯) কবিতাগ্রন্থে তার রয়েছে অসামান্য কৃতিত্বের স্বাক্ষর। ‘জুলেখার মন’ ছাড়াও অন্ধকারে একা’, ‘রক্তিম হৃদয়’ (১৯৭০), ‘আপন ভুবন (১৯৭৫) তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য-সমালােচক হিসেবেও ততােধিক খ্যাতি অর্জন করেছেন। নজরুল ইসলাম ও আধুনিক বাংলা কবিতা’, ‘বাংলা কাব্যে মুসলিম ঐতিহ্য’, ‘সমকালীন সাহিত্যের ধারা’, ‘আধুনিক কাব্যে কুমিল্লা জেলার অবদান’, সাহিত্যে-সংস্কৃতি-জাতীয়তা’, ‘মধুসূদন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কাব্যের শিল্পরূপ’, ‘কবিতা ও প্রসঙ্গ কথা’ প্রভৃতি তাঁর উল্লেখযােগ্য প্রবন্ধগ্রন্থ। তিনি ১৯৭৭ সালে কবিতার জন্য বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। মােহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি আশুগঞ্জের নাওঘাট গ্রামে।

ফজল শাহাবুদ্দীন : তৃষ্ণার অগ্নিতে একা’, ‘আকাঙ্ক্ষিত অসুন্দর’, ‘অন্তরীক্ষে অরণ্য’, ‘সান্নিধ্যের আর্তনাদ’, ‘আলােহীন-অন্ধকারহীন’, ‘অন্তহীন দরােজা’, ‘দিক চিহ্নহীন’, ‘ছায়া ক্রমাগত’, ‘ক্রন্দনধ্বনি’, ‘নিসর্গের সংলাপ’, ‘হে নীল সমুদ্র হে বৃক্ষ সবুজ’, ‘অন্তগত হাহাকার প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থেও তিনি সমান পারদর্শী। ফজল শাহাবুদ্দীনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি নবীনগর উপজেলার শাহপুর গ্রামে।

আহমেদ হুমায়ুন : সাংবাদিক লেখক আহমেদ হুমায়ূনের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১৮ মে নবীনগর উপজেলার শাহবাজপুর গ্রামে। তিনি প্রবন্ধ এবং গল্প লিখেছেন। বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর উল্লেখযােগ্য গ্রন্থ। আহমেদ হুমায়ুন একজন শক্তিশালী গদ্য লেখক হিসেবে সুপরিচিত। | ‘বিপরীত স্রোতে রবীন্দ্রনাথ’ ছাড়াও ‘আলেক মিঞার পার্লামেন্ট’, ‘সু-পান্থ’, ‘নগর দর্পন’ ইত্যাদি তাঁর গদ্য শৈলীর উজ্জ্বল নিদর্শন। তিনি একজন সার্থক অনুবাদকও। তার ‘ঢাকাই লিমেরিক’-এ ছন্দ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার সম্পাদক ছিলেন।

নাট্যকার আজিজ মিসির : আজিজ মিসির ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মেরাতুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম সিরাজুল ইসলাম। দেশ বিভাগের পূর্বে কলকাতা থাকাকালীন তিনি ছােটগল্প লিখে সুনাম অর্জন করেছিলেন। আজিজ মিসির চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখকও। তিনি অসংখ্য নাটক লিখেছেন। যার ফলে sec একজন সফল নাট্যকার হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন ।

মিন্নাত আলী : মিন্নাত আলীর জন্ম ভৈরবে হলেও কর্মজীবন কাটিয়েছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। প্রথমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং পরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহিলা কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। তাঁর রচিত ‘আমার প্রথম প্রেম’, ‘চেনা ও জানা’, ‘আমি দালাল বলছি’, ‘না বলা কথা’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।

খুরশেদুল ইসলাম : প্রচার-বিমুখ নিভৃতধারার কবি ছিলেন খুরশেদুল ইসলাম। কবিতায় তাঁর মননশীলতার শিল্পরূপ পাঠকমাত্রকেই মােহিত করে। পঞ্চাশের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা কবিতার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ‘উঠানে দুঃখের জল’, ‘তােমার চরণ ছুয়ে অন্ধকার জ্বলে’, ‘উত্তর সাধক’, ‘তােকে আমি ভালবাসি’, ‘আমার প্রিয়ার চন্দন তিলক’, ‘সেতারা হেলাল নামে তােমাকে ডেকেছি’, তাঁর উল্লেখযােগ্য কাব্যগ্রন্থ। কবি ও শিক্ষাবিদ খুরশেদুল ইসলামের জন্ম ১৯৩৭ সালে সরাইল উপজেলার পরমানন্দপুর গ্রামে। তিনি ২০০৭ সালের ২৯ মে মৃত্যুবরণ করেন।

সৈয়দ আব্দুল কাহহার : সৈয়দ আবদুল কাহহার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মৌড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দীর্ঘদিন দৈনিক পাকিস্তান ও পরে দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি ‘সমদর্শী’ ছদ্মনামে কলাম লিখে সুনাম অর্জন করেছেন। সৈয়দ আবদুল কাহহার ঢাকাস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমিতির পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও পরে ‘শাশ্বত ব্রাহ্মণবাড়িয়া’-এর মােট চারটি সংখ্যা সম্পাদনা করেন, যা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ।

খান মােহাম্মদ ফারাবী : খান মােহাম্মদ ফারাবীর জন্ম ১৯৫২ সালের ২৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌলভীপাড়ায়। সাহিত্য চর্চার শুরুতেই তিনি চমক সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর রচিত কবিতা ও অন্যান্য ‘মামার বিয়ের বরযাত্রী’ (গল্প), এক ও অনেক’ (প্রবন্ধ), ‘আকাশের উপরে আকাশ’ (নাটক), নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মােচন করেছিল ! কিন্তু ১৯৭৪ সালের ১৫ মে অপার সম্ভাবনাকে ম্লান করে দিয়ে মাত্র ২২ বছরেরও কম রয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান

ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রায় দুইশ বছরের আন্দোলন সংগ্রামের পর-১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ভারতবর্ষের হিন্দু ও মুসলমানদের জন্য আলাদা দুটি রাষ্ট্র হিন্দুস্থান বা ভারত এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়। আপস-আলােচনার মাধমেই তা হলাে। প্রায় দুইশ বছর শাসন ও শােষণ করার পর এদেশ থেকে বিদায় নিল ব্রিটিশ সামাজ্যবাদ। কিন্তু রেখে গেল তাদের চক্রান্ত এবং শােষণের নমুনা। বিপ্লবীদের হাতে ক্ষমতা থাকেনি । ক্ষমতা চলে যায় সুবিধাভোগী শাসকশ্রেণীর হাতে

১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে পৃথক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তানের একাংশ পূর্ব-বাংলা বা পূর্ব-পাকিস্তান এবং অন্য অংশ পশ্চিম-পাকিস্তান নামে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান বা পর্ব-বাংলাকে রাজস্ব আদায় এবং শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্যের পশ্চাৎভূমি হিসেবে পরিগণিত করতে চাইল । প্রথমেই আঘাত হানল ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। তার বিরুদ্ধে সােচ্চার হলাে পূর্ব-বাংলার সচেতন জনগণ। শুরু হলাে পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে আন্দোলন।

ভাষা আন্দোলন : ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে তৎকালীন পাকিস্তান। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে পরিষদ পরিচালনার নিয়ম-কানুনে বলা হয় যে, পরিষদের আলােচনায় ইংরেজি অথবা উর্দু ছাড়া অন্য কোনাে ভাষা ব্যবহার করা যাবে না। পরিষদের সদস্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম ব্যক্তি যিনি ভাষার প্রশ্নে সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন এবং বাংলা ভাষাকে সমান মর্যাদা দানের দাবি জানান। এ ব্যাপারে আপত্তি উঠেছিল, কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (শহীদ বুদ্ধিজীবী ১৯৭১) পিছপা হননি, যুক্তি দিয়ে মােকাবিলা করেছেন ।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে সারা দেশে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হলাে। শতকরা ছাপ্পান্ন জনের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার অপপ্রয়াসকে চ্যালেঞ্জ করল বাংলার মানুষ । এখান থেকেই এদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারার সংযােজন ঘটতে শুরু করল।

সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ সেস্নাগান। সারা দেশের মতো। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও গঠিত হলাে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। ১৯৫১’র এ ফেব্রুয়ারি গঠিত এ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ছাত্র সংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান। এ ছাড়া যারা এ সংগঠনের সাথে সক্রিয় ছিলেন তারা হলেন : সামিউল আহমদ খান ফটিক, সগির আহমদ খান মহিউদ্দিন আহমদ, সফিউদ্দিন আহমদ, মিজানুর রহমান, আবিদুর রহমান, জিয়াউদ্দিন আহমদ, লুৎফুর রহমান (১৯৭১ সালে শহীদ বুদ্ধিজীবী), শওকত হায়দার, ফরিদ। উদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক মােহাম্মদ হােসেন, মুহম্মদ মুসা প্রমুখ । বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি সারা দেশের মতাে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। ওইদিন রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খবর পৌঁছায় যে, পুলিশের গুলিতে ঢাকায় বহু ছাত্র আহত ও নিহত হয়েছে। এ সংবাদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা এলাকায় আন্দোলনের ঝড় ওঠে। পরদিন ২২ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সর্বত্র বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা তৎকালীন কাছারি ভবনের ওপর থেকে পাকিস্ত ানের পতাকা নামিয়ে ফেলে। পতাকা নামানাের অপরাধে ছাত্র নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হয়। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি, সর্বত্র দুর্বার আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এ আন্দোলনে সেদিন ছাত্রনেতা সামিউল আহমদ খান ফটিক, আবদুর রহমান খান, শরীফ আবদুল্লাহ হারুন ও মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এড. আবদুল বারী গ্রেপ্তার হয়ে কারা নির্যাতন ভােগ করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি স্কুলকলেজ, পাড়া-মহল্লা এবং গ্রাম পর্যায়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র-জনতার পাশাপাশি স্কুল-কলেজের ছাত্রী এবং মহিলারাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে সুলতানা রাজিয়া, হােসনে আরা রহমান, আম্বিয়া বেগম (আজম), রহিমা খাতুন হেনা, হােসনে আরা হক, রােকেয়া বেগম, মােহসেনা, রওশন আরা হেনা প্রমুখ নেতৃত্বদানের ভূমিকা পালন করেছেন।

২৭ফেব্রুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ শিক্ষক পরিষদের এক জরুরি সভায় ছাত্রদের উপর গুলি বর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করে অবিলম্বে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবি জানানাে হয়।

ভাষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার যারা বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে আরও যাদের নাম জানা গেছে তারা হলেন : আহমদ আলী, আলী আজম ভূঞা, আবুল বাশার মৃধা, আল মাহমুদ, ফরিদুল হুদা, আলী আজগর, আহমদ রফিক, রইছউদ্দিন ফুল মিয়া, আবদুল মালেক ভূঞা, আবদুল গণি মুন্সি, আবদুর রউফ হামদু মিয়া, কাজী রফিকুল ইসলাম, মাে. তাজুল ইসলাম, অলি আহাদ, কসবার গেদু মিয়া, বড় মিয়া, সরাইলের আবদুস সামাদ, আবু হামেদ প্রমুখ ।।

সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন : পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংগঠিত রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তােলার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রােজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ঢাকায় কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পর থেকেই সারা দেশে সাংঠনিক তৎপরতা শুরু হয়। ঢাকার বাইরে। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সাংগঠনিক সভা হয় ব্রাহ্মণবাডিয়ায়।

১৯৪৯ সনের ৩ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লােকনাথ ময়দানে আয়ােজিত জনসভায় কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক উপস্থিত ছিলেন। কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য আলী আমজাদ খানের সভাপতিত্বে সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মুসলিম লীগের শােষণনীতির তীব্র সমালােচনা করা হয় । জনসভার পর ওই দিন রাতে অনুষ্ঠিত হয় সাংগঠনিক সভা। এ সভায় এডভােকেট আবদুল বারীকে সভাপতি ও রফিকুল। ইসলামকে (রফিক মাস্টার) সাধারণ সম্পাদক করে আওয়ামী মুসলিম লীগের। বাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা কমিটি গঠন করা হয়। | ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হওয়ার পর থেকে এখানে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের শােষণনীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়। পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে কমিটি গঠন করে আন্দোলন ছড়িয়ে দেওয়া হয় । ছাত্রনেতৃবৃন্দকে নিয়ে গঠিত হয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটি। তৎকালীন মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন আলী আজম ভূইয়া, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবদুর রহমান (বড়হরণ)। আলী আজম ভূঁইয়া তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন। কেন্দ্রীয় পর্যায়েও তিনি ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন।

আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তৎকালীন মহকুমা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে এডভােকেট আবদুল বারী ও এডভােকেট আলী আজম ভূঁইয়া নির্বাচিত হন। সারা দেশের মতাে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও শােষক মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরদার করা হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে রাজনৈতিক কর্মকান্ড কিছুদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। তবে গােপনীয়ভাবে রাজনৈতিক তৎপরতা চলতে থাকে ।

১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে এবং বাঙালির ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করেন। শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ছয় দফার প্রতি পূর্ব-বাংলার জনগণ অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এ আন্দোলন দমানাের জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধান আসামি করে ১৯৬৭ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। এর প্রতিবাদে বাংলার মানুষ সােচ্চার হয়ে ওঠে। এ সময় ‘আঘাত হানার দিন এসেছে’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্রনেতা মাহবুবুল হুদা ভূইয়া এবং শফিক খান গ্রেফতার হন। কিন্তু আন্দোলন থেমে থাকেনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়াস্থ নবীনগরের গােপালপুর গ্রামের মাে. মুজিবুর রহমান (সাবেক হাবিলদার) ছিলেন আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলায় অন্যতম আসামি।

আওয়ামী লীগের ছয় দফা আন্দোলনের পাশাপাশি ছাত্রলীগ ১১ দফা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘােষণা করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এ আন্দোলন জোরদার করা হয়। ছয় দফা ও ১১ দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী গ্রেফতার হন। অনেকে গ্রেফতারি পরােয়ানা নিয়েও আন্দোলনে জড়িত থাকেন। কেউ কেউ আত্মগােপন করেন। এ আন্দোলনই পর্যায়ক্রমে গণআন্দোলনের রূপ নেয়।

১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান সরকার সারা দেশে তথাকথিত উন্নয়নের এক দশক পালনের কর্মসূচি দেয়। এ কর্মসূচি পালনের লক্ষ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ছাত্রনেতবৃন্দ এ কর্মসূচির প্রতিবাদ জানায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে নির্মিত প্রধান ফটকটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে মামলা হয়। কিন্তু আন্দোলন দমানাে যায়নি। বরং এ আন্দোলন তীব্রতর হয়ে পর্যায়ক্রমে গণআন্দোলনে রূপ নেয়। তীব্র গণআন্দোলনের চাপে শাসক আইয়ুব খান সরে যেতে বাধ্য হয়। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খান নতুন করে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে পূর্ব-পাকিস্তানের উপর তীব্র দমননীতি চালায়। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে আন্দোলনের ওপর বিধি-নিষেধ আরােপ করলেও জনতার আন্দোলন থেমে থাকেনি। শেষ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানও আন্দোলনরত জনতাকে দমন করতে ব্যর্থ হয়। এ সময় সারাদেশের মতাে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়ও আন্দোলনের কর্মসূচি চলতে থাকে। বাধ্য হয়েই ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা করে। জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটে সরকার নির্বাচনের দাবি মেনে নেওয়া হয়।

১৯৭০ সালের ৭ এবং ১৭ ডিসেম্বর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রতিটি আসন থেকে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থী জয়লাভ করেন। জাতীয় পরিষদে যারা নির্বাচিত হন তাঁরা হলেন, তাহের উদ্দিন। ঠাকুর (১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যা-মামলার অন্যতম আসামি), এডভােকেট আলী আজম ভূইয়া, এডভােকেট সিরাজুল হক ও দেওয়ান আবুল আব্বাস। প্রাদেশিক পরিষদে যারা নির্বাচিত হন তাঁরা হলেন মােজাম্মেল হক (কাপতান মিয়া), এডভােকেট সৈয়দ সিরাজুল ইসলাম, এডভেকেট লুফুল হাই সাচ্চু, এডভােকেট সৈয়দ এমদাদুল বারী, এড. আহমদ আলী, কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক ও গােলাম মহিউদ্দিন আহমেদ (আফতাব মিয়া)। এ ছাড়া তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের মাত্র দু’টি আসন ছাড়া সবকটি আসনে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থী বিপুল ভােটে জয়লাভ করে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে আওয়ামী লীগ মনােনীত প্রার্থী বিজয়ী হন। এ নির্বাচনে পূর্ব-বাংলার জনগণ আওয়ামী লীগের ছয় দফা দাবির পক্ষে সুস্পষ্ট রায় প্রদান করে। পক্ষান্তরে মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম, পি.ডি.পি. ইসলামী ঐক্যজোট প্রভৃতি সাম্প্রদায়িক দলগুলােকে জনগণ প্রত্যাখান করে। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ঐসব সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। পরাজিত ঐসব দলের প্রার্থী এবং সমর্থকরা জনগণের সুস্পষ্ট রায়কে বানচাল করার জন্য নানা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের জাল বিস্তার করতে থাকে। তাদের সাথে যুক্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী ও সামরিকচক্র। এ চক্রান্তের কারণেই আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করেও সরকার গঠন করতে পারে নি। আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করতে হয়েছে। এ আন্দোলনেও জনগণ। স্বতস্ফূর্ত সাড়া দিয়েছে। একাত্তরের ২৫মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি পূর্ব। বাংলার উপর নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। তার প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ালাে সমগ্র বাঙালি জাতি। শুরু হলাে সশস্ত্র যুদ্ধ।

সশস্ত্র যুদ্ধ : ১৯৭১ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে। পাকিস্তানবাহিনির বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনির সম্মুখযুদ্ধ এবং গেরিলা আক্রমণ সংঘটিত হয়েছে। জেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে গড়ে উঠেছিল মুক্তিবাহিনির গেরিলা বেইজ। কসবা। থানাধীন চারগাছ, রাইতলা, শিমরাইল, মেহারী ঈশাননগর, বলভপুর, চৌবেপুর, শিকারপুর, বাদৈরবাজার, মান্দারপুর, জয়দেবপুর, লাতুয়ামুড়া, চকচন্দ্রপুর, গােপীনাথপুর, কুঠি, কালামুড়িয়া, মইনপুর, জগন্নাথপুর, মন্দভাগ, কাইমপুর, বায়েক, সালদা নদী, কোলাপাথর, রঘুনাথপুর, অষ্টজঙ্গল, কসবা স্টেশন, পুরানবাজার, ঈমামবাড়ি, লক্ষ্মীপুর, আড়াইবাড়ি, ঝিকরা প্রভৃতি এলাকায় পাকবাহিনির সাথে মুক্তিবাহিনির সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।

আখাউড়া থানার যেসব এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে তা হলাে ধরখার ইউনিয়নের উজানিসার ব্রিজ, ধরখার গ্রাম সংলগ্ন সড়ক, মনিয়ন্দ ইউনিয়নের কর্নেলবাজার, মনিয়ন্দ, নােয়ামুড়া, উত্তর মনিয়ন্দ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম মাঠ, মনিয়ন্দ রেলব্রিজ এলাকা, সােয়ার দিঘির পাড় গিরীশনগর, পাথারিয়া টেক, মােগড়া ইউনিয়নের দরুইন রেললাইন এলাকা, বচিয়ারা নিলাখাদ, মােগড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দক্ষিণ-পশ্চিম পাশে কাকিনা ব্রিজ, মােগড়া বাজার, গঙ্গাসাগর, গঙ্গাসাগর রেলসেতু, জয়নগর চেকপােস্ট এলাকা, হাওড়া নদী, গাঙভাঙ্গা, আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের আখাউড়া ইপিআর হেডকোয়ার্টার থেকে বড় বাজার ও সড়ক বাজার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা, তারাগন, দেবগ্রাম, নারায়ণপুর, নূরপুর, হীরাপুর, কুড়িপাইকা, ফকিরমােড়া, আনন্দপুর, গাজীরবাজার, আব্দুলাহপুর থেকে আখাউড়া রেল কলােনি, আখাউড়া তিতাস ব্রিজ এলাকা, দুর্গাপুর, খড়মপুর, আজমপুর, মসজিদ পাড়া, কৌড়াতুলী, আমােদাবাদ ইত্যাদিসহ প্রায় সমগ্র আখাউড়া অঞ্চল।

তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর থানাধীন নবগঠিত বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের কালাছড়া চা-বাগান, কঙ্কর বাজার, ঘাঁটির মােড়, বিষ্ণুপুর, সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের সিঙ্গারবিল, কাশিননগর, মেরাসানী, কাশিপুর ব্রিজ, মিরাসানী বাজার, রেলস্টেশন, চান্দুরা জলিলপুর, আউলিয়াবাজার, চান্দপুর, আলিপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার নাটাই, নন্দনপুর সড়ক সুলতানপুর ইউনিয়নের আহরন্দ ও মহিউদ্দিন নগরের মধ্যবর্তী এলাকা, মজলিশপুর ইউনিয়নের দারমা-মজলিশপুর-সড়ক, সাদেকপুর ইউনিয়নের বিরামপুর, আশুগঞ্জ থানার লালপুর, ভৈরব-আশুগঞ্জ রেলব্রিজ সােহাগপুর, বাহাদুরপুর, ও দুর্গাপুর মাঠ, আজবপুর, আশুগঞ্জ, মেঘনা ঘাট ও তাপ-বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ আশুগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে।

নাসিরনগর থানার তুলাপাড়া ও পুলিশ স্টেশন, সরাইল থানার বিটঘর, বেড়তলী, শাহবাজপুর বাজার এলাকা, সরাইল পুলিশ স্টেশন, নবীনগর থানার বিদ্যাক্ট, গুড়িগ্রাম, থানা ভবন এলাকা, দড়িলাপাং, বড়াইল, খারঘর, নবীনগর হাইস্কুল এলাকা, পুরাতন জমিদার বাড়ি, বাজার এলাকা এবং বাঞ্ছারামপুর থানার থানাভবন এলাকা, মরিচাকান্দি, তিতাস ও মেঘনা নদী এবং ঘাগােটিয়া নদীর দক্ষিণ পাড়সহ বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে।

এ ছাড়া জেলার পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কসবা, আখাউড়া, বিজয়নগর ও সদর থানার সীমান্ত এলাকায় মে মাস থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে । নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের মধ্যে সমগ্র সীমান্ত এলাকা মুক্তিবাহিনির নিয়ন্ত্রণে আসে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান নদী তিতাস। নাসিরনগরের চাতলপাড় এলাকায় মেঘনা থেকে উৎপন্ন হয়ে সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, আখাউড়া, নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এ নদীটি পুনরায় মেঘনা নদীতে মিলিত হয়েছে। তিতাসের শাহবাজপুর সড়ক সেতু, আখাউড়া রেলসেতু, উজানিসার সড়ক সেতু, নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুরের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানবাহিনির সাথে মুক্তিবাহিনির সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছে। কসবা থানার সালদা নদী এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। মেঘনা নদীর লালপুর, ভৈরব-আশুগঞ্জ রেলব্রিজ ও আশুগঞ্জ-আজবপুর এলাকায় যুদ্ধ হয়েছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের উত্তর দিকে সরাইল ও নাসিরনগর থানা, পশ্চিমে আশুগঞ্জ ও মেঘনা নদী, দক্ষিণে আখাউড়া ও কসবা থানা, দক্ষিণ-পশ্চিমে নবীনগর ও বাঞ্ছারামপুর থানা এবং পূর্ব দিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে হবিগঞ্জ, কিশােরগঞ্জ, নরসিংদী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলার সাথে সরাসরি সড়ক যােগােযােগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এসব এলাকার গেরিলাযােদ্ধারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর দিয়েই যাতায়াত করেছে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা বাংলাদেশের মধ্য-পূর্বাঞ্চলে হওয়ায় এদিক দিয়ে প্রায় সারা দেশের সাথেই মুক্তিযােদ্ধাদের যােগাযােগ ছিল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকায় পরিণত হয়েছিল। এর প্রধান কারণ ভৌগােলিক অবস্থান। উত্তরে হবিগঞ্জ থেকে দক্ষিণে কুমিলা জেলার ব্রাহ্মণপাড়া পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, আখাউড়া, বিজয়নগর ও সদর থানার বিস্তীর্ণ এলাকা প্রায় ৬৫ কি. মি. সীমান্ত অঞ্চল। এখান থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সাথে রয়েছে সহজ যােগাযােগ ব্যবস্থা। সীমান্ত এলাকা এবং সীমান্তের ওপার থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গেরিলাবাহিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ওপর দিয়েই দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে। বিভিন্ন এলাকায় শত্রম্নবাহিনির উপর আক্রমণ করেছে। গেরিলাবাহিনির পাশাপাশি নিয়মিত বাহিনিও সবসময়ই এখানে তৎপর ছিল । মুক্তিযুদ্ধের প্রায় নয় মাসই বিভিন্ন এলাকায় সংঘটিত হয়েছে সম্মুখ যুদ্ধ। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দশ সহস্রাধিক মুক্তিযােদ্ধা ট্রেনিং নিয়ে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এ ছাড়া বিচ্ছিন্ন কিছু দালাল রাজাকার ব্যতীত তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার প্রায় ১০ লাখ মানুষই প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা করেছেন। ফলে মুক্তিযুদ্ধ এখানে মূলত একটি জনযুদ্ধ পরিণত হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধীরা তখন এক ধরনের জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সমগ্র বাংলাদেশকে মােট ১১টি সেক্টরে ভাগ করা। হয়েছিল। প্রতিটি সেক্টরকে আবার কয়েকটি করে সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে কসবা, গঙ্গাসাগর ও আখাউড়া থেকে পশ্চিমে ভৈরববাজার রেললাইন পর্যন্ত ছিল ২নং সেক্টর এবং পূর্বে সিঙ্গারবিল থেকে উত্তরে হবিগঞ্জ পর্যন্ত ছিল ৩ন সেক্টবেব অন্তর্ভুক্ত।

২নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মােশরাফ (পরে মেজর। জেনারেল বীরউত্তম, ১৯৭৫ এর সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত)। তিনি তার সেক্টরকে। ছয়টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করেন। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ কসবা, আখাউড়া, গঙ্গাসাগর সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন মােহাম্মদ আয়েনউদ্দিন (পরে মেজর জেনারেল অব. বীরপ্রতীক, পিএসসি) তার সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন মাহবুব, লেফটেন্যান্ট ফারুক ও লেফটেন্যান্ট হুমায়ূন কবির । এই এলাকায় চতুর্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানি এবং ইপিআর এর দুটি কোম্পানি ছিল। তাদের সঙ্গে মর্টারেরও একটি দল ছিল। এই সাবসেক্টর কসবা, আখাউড়া, সৈয়দাবাদ, নবীনগর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লার মুরাদনগর পর্যন্ত অপারেশন চালাত। ক্যাপ্টেন আয়েনউদ্দিন নবম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। নিয়মিত-অনিয়মিত এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলা সৈনিকদের নিয়ে অক্টোবর মাসে নবম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠিত হয়েছিল ।

মন্দভাগ সাব-সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন এইচ.এম.এ গাফফার (পরে লে. কর্নেল অব. বীর উত্তম)। তার অধীনে চতুর্থ বেঙ্গলের সি বা চার্লি কোম্পানি এবং মর্টারের একটি দল ছিল। এই সাবসেক্টর বাহিনি কসবা থানার মন্দভাগ রেলস্টেশন থেকে কুটি পর্যন্ত অপারেশন চালাতাে। এ ছাড়া সালদা নদী কোনাবন সাবসেক্টর কমান্ডার হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। একাধারে তিনি ব্যাটেলিয়ান ও সাবসেক্টর কমান্ডার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কমান্ডে সৈন্যসংখ্যা ছিল প্রায় চৌদ্দশ’। এর মধ্যে আটশ’র মতাে ছিল ব্যাটেলিয়ান সৈন্য, আর প্রায় ছয়শ’ সৈনিক নিয়ে গঠিত হয়েছিল সাবসেক্টর ট্রপস । বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ এবং যুদ্ধকালীন প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তােলা সৈনিকরা ছিল ব্যটালিয়নের অন্তর্ভুক্ত। আর সেক্টর ট্রপস এর মধ্যে ছিল ছাত্র-যুবক ও কৃষকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মুক্তিযােদ্ধা। স্বল্প। সময়ের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে যুদ্ধোপযােগী করে গড়ে তােলা হয়েছিল। তারা এফ. এফ বা ফ্রিডম ফাইটার, বিএফ বা ভিত্তি ফৌজ এবং এমএফ বা মুক্তিফৌজ বলে পরিচিত হতেন। তাঁরা ছিলেন দেশের কৃষক-শ্রমিক ও ছাত্র-যুবকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে তারা খুবই সাহসিকতাপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বিভিন্ন। যুদ্ধক্ষেত্রে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

ক্যাপ্টেন গাফফারের এই ব্যাটেলিয়নে চারটা কোম্পানি ছিল। এর মধ্যে এ বা আলফা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার গােলাম আম্বিয়া। বি বা ব্রাডাে কোম্পানির কমান্ডার সুবেদার ফরিদ সি বা চার্লি কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার আবদুল ওহাব (বীর বিক্রম) এবং ডি বা ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার তাহের। ব্যাটেলিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন লেফটেন্যান্ট কবির (পরবর্তী পর্যায়ে ক্যাপ্টেন কবির) আর মেডিকেল অফিসার ছিলেন লেফটেন্যান্ট ডা. আখতার (পরবর্তী পর্যায়ে মেজর)। এই ব্যাটালিয়ানে দুটি মর্টার প্লাটুন ছিল। এর একটার কমান্ডার ছিলেন সুবেদার জব্বার এবং অন্যটির কমান্ডার ছিলেন সুবেদার মঈন (বীর উত্তম)। সালদা নদী-মন্দভাগ এলাকার যুদ্ধে তিনি শহিদ হন। সুবেদার জহির ছিলেন প্লাটুন কমান্ডার। আর টুআইসি ছিলেন ক্যাপ্টেন কবির। ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টারে তিনি

অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখাশােনা করতেন। অপারেশনের সার্বিক দায়িত্ব পরিচালনা করতেন। ক্যাপ্টেন গাফফার। তার অধীনে বিভিন্ন ট্রপস্ এবং প্লাটুনের দায়িত্ব পালন করতেন ফ্লাইট লে. কামাল, সুবেদার সহিদ, সুবেদার সিরাজ, সুবেদার বেলায়েত, সুবেদার মুনির প্রমুখ । কোয়ার্টার মাস্টারের দায়িত্ব পালন করতেন সুবেদার মনসুর।

কসবা থেকে মন্দভাগ রেলস্টেশনের উত্তর পাশ পর্যন্ত আলফা কোম্পানির দায়িত্বে ছিল। ব্রাডাে কোম্পানির দায়িত্বে ছিল মন্দভাগ রেলস্টেশন এলাকা। মন্দভাগ। রেলস্টেশনের পর থেকে সালদা নদীর মাঝামাঝি নাগাদ, অর্থাৎ রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত এলাকার দায়িত্বে ছিল চার্লি কোম্পানি। চার্লি কোম্পানির এলাকা বাদ দিয়ে রেলওয়ে ব্রিজ থেকে সালদা নদী এবং সালদা নদী রেলস্টেশন এলাকা ছিল ডেলটা কোম্পানির দায়িত্বে। ব্যাটালিয়ান হেডকোয়ার্টার ছিল কোনাবনে। ২নং সেক্টর এলাকায় যুদ্ধকালীন প্রায় প্রতিদিনই সম্মুখ যুদ্ধ এবং গেরিলা আক্রমণ হয়েছে। প্রতিটি যুদ্ধেই মুক্তিবাহিনি সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এরই ধারাবাহিকতায় ২১ ও ২২ অক্টোবরের সম্মুখ যুদ্ধে কসবার পুরান বাজার শত্রম্নমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনির ১৫জন সৈনিক শহিদ এবং সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মােশাররফসহ ২৭জন আহত হয়।কসবা সদর এলাকায় পরাজয় বরণ করে পাকবাহিনি কুটির দিকে সরে যায়। কিন্তু কসবা সদর থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে লতুয়ামুড়া, চন্দ্রপুর এবং আখাউড়ায় পাকবাহিনির শক্তিশালী ঘাটি ছিল। লতুয়ামুড়া ও চন্দ্রপুরের যুদ্ধেও মুক্তিবাহিনির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসময় মিত্রবাহিনীর ভূমিকায় মুক্তবাহিনির পাশে ছিল ভারতীয় বাহিনি । তবুও এ যুদ্ধে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। যৌথবাহিনির প্রায় ছয়শ’ সৈনিক এখানে নিহত হয়েছে। প্রায় সপ্তাহ খানেক ক্রমাগত যুদ্ধের পর ৪/৫ডিসেম্বরের মধ্যে লতুয়ামুড়া, চন্দ্রপুর মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। লতুয়ামুড়া ও চন্দ্রপুর দখলের মধ্য দিয়ে সমগ্র কসবা থানা হানাদার মুক্ত হয়। কসবা থেকে পরাজিত পাকবাহিনি আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লার দিকে সরে যায়।

তিন নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর কে এম সফিউলাহ বীর উত্তম (পরে মেজর জেনারেল ও সেনাবাহিনির প্রধান অব.)। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পূর্ব দিকে সিঙ্গারবিল থেকে উত্তরে শ্রীমঙ্গলের নিকট চুড়ামনকাঠি পর্যন্ত এই সেক্টরের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এই সেক্টরের আওতায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, নাসিরনগর, নবীনগর, আশুগঞ্জ, মুকুন্দপুর, প্রভৃতি এলাকায় এবং বিভিন্ন গ্রামে গেরিলা বেইস গড়ে উঠেছিল। মে মাস থেকেই এসব এলাকায় গেরিলা পদ্ধতিতে পাকবাহিনির ওপর আক্রমণ শুরু হয়েছিল। নভেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ত্রিশ হাজার গেরিলা ও গণবাহিনীর সদস্য এই সেক্টর এলাকায় যুদ্ধ করেছে। সুষ্ঠু অপারেশন চালাবার জন্য এই সেক্টরকে ১০টি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়েছিল।

এপ্রিল মাসে ৩নং সেক্টরের ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং মাধবপুর পাকবাহিনির দখলে চলে যাবার পর মে মাসে পাকবাহিনি সিলেট অঞ্চল থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং ঢাকার। সাথে সড়ক পথে যােগাযােগ শুরু করে। তাদের এই যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার জন্য মুক্তিবাহিনি সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের কয়েকটি ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। কিও পাকবাহিনি বিকল্প ব্রিজ এবং সড়ক প্রস্তুত করে নেয়।

১৪ মে রাতে ৩নং সেক্টরের সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. হেলাল মােরশেদের নেতৃত্বে। মুক্তিযােদ্ধার একটি দল সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের বিকল্প পথে দুটি ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন পেতে ওৎ পেতে বসে থাকেন। পরদিন ১৫মে সকালের দিকে পাকবাহিনির গাড়ির বহর সিলেট থেকে ঢাকার দিকে অগ্রসর হয়। গাড়ির বহরটি মাইনের আওতায় আসতেই সামনের দুটি গাড়ি ছিটকে পড়ে যায়। এমতাবস্থায় অন্য গাড়িগুলাে আর অগ্রসর হওয়ার সাহস পায়নি। মাইনের আঘাতে হতাহতদের নিয়ে সিলেটের দিকে। ফিরে যায় ।

পর্যায়ক্রমে মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে পাকবাহিনিকে নাস্ত নাবুদ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন এলাকায় গেরিলা তৎপরতা এত দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় যে, পাকবাহিনি সর্বত্র ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এই গেরিলা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য পাকবাহিনি বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে নিয়মিত বাহিনির সৈন্য ছাড়াও অসংখ্য রাজাকার এবং অন্যান্য সহায়ক শক্তি নিয়ােগ করতে থাকে। গ্রামে গ্রামে গড়ে তােলে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর এবং আলশামস বাহিনি। মুক্তিযােদ্ধারাও গেরিলা পদ্ধতিতে বিভিন্ন গ্রাম, ইউনিয়ন এবং থানা পর্যায়ে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রায় প্রতিনিদই ৩নং সেক্টর এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ এবং গেরিলা আক্রমণ হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৮ ও ১৯ নভেম্বর দু’দিনের যুদ্ধে ২৮জন পাকসেনার আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ৩নং সেক্টরের মুকুন্দপুর এলাকা হানাদার মুক্ত হয়।

৩০ নভেম্বর থেকে আখাউড়া ও বিজয়নগরের সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনির সাথে মুক্তিবাহিনির প্রচণ্ড লড়াই শুরু হয়। ৩ ডিসেম্বরের মধ্যে বিজয়নগর ও আখাউড়ার সীমান্ত এলাকা মুক্তিবাহিনির দখলে আসে। ৩ ডিসেম্বর আখাউড়া রেলষ্টেশন এলাকায় প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। ৬ ডিসেম্বরের মধ্যে সমগ্র আখাউড়া এলাকা হানাদার মুক্ত হয়। ৮ ডিসেম্বর মুক্ত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর এলাকা। পর্যায়ক্রমে সমগ্র ব্রাহ্মণবাড়িয়া মুক্তিবাহিনির দখলে আসে। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনি ঢাকায় আত্মসমর্পন করে। দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় শতাধিক গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে। বিভিন্নভাবে নির্যাতিত হয়েছে লক্ষাধিক নারী-পুরুষ। হত্যার শিকার হয়েছে দশ সহস্রাধিক (স্থানীয় ও অস্থানীয় মানুষ। অবরুদ্ধ ছিল জেলার (তৎকালীন মহকুমা) দশ লাখ অধিবাসী।

উপসংহার মুক্তিযুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগ মূলত নেতৃত্বদানের ভূমিকা পালন করেছে। তবে দলমত নির্বিশেষে সকল স্তরের জনগণের অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফুর্ত। আওয়ামীলীগের স্বতন্ত্র সংগঠন ছাত্রলীগ এবং আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া স্বাধীনতা বিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল কিছু রাজনৈতিক দলের সদস্য ব্যতিত বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক,

রাজনৈতিক, ছাত্র ও পেশাজীবী সংগঠনসহ সমাজের সকল স্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ এস | পরােক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। সবার অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই মত। | ব্যাপকতা পেয়েছিল। প্রাথমিকভাবে সর্বদলীয়ভাবে গঠিত স্বাধীন বাংলা ১ পরিষদের ভূমিকাও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ পরিষদই মুক্তিযুদ্ধের সাংগঠনিক তৎপরতা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে এসেছিল। আর ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং সহযােগিতাই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত করেছে। এক্ষেত্রে জনগণের ভূমিকাই অধিক গুরুত্বপূর্ণ।

বিখ্যাত গায়ক, শিল্পী ও কবিয়ালদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়

তীর্থভূমি শিবপুর : সংগীত ঐতিহ্যের তীর্থভূমি নবীনগর থানার শিবপুর গ্রাম। আনুমানিক আঠার শতকের শেষার্ধে এখানে সুর ও সংগীতের বিশেষ আলােকবর্তিকার প্রজ্জ্বলন ঘটান সংগীত সাধক সবদর হােসেন খাঁ। উপমহাদেশের সংগীত ধারায় শিবপুরের খ্যাতির কোনাে তুলনা নেই। মূলত সবদর হােসেন খাঁ’র পরিবার থেকে বহু শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত হয়ে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সংগীত গৌরব ।

সবদর হােসেন খাঁ : সংগীত মনীষী সদু খাঁ ওরফে সবদর হােসেন খা সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায় না। তার জন্ম নবীনগর থানার শিবপুর গ্রামে। শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন সংগীতের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত। সংগীত চর্চায় তিনি এক অনন্য পারিবারিক ঐতিহ্যের সূচনা করেন।

ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ : ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ’র জন্ম শিবপুর গ্রামে। পিতার মতাে তিনিও শৈশবেই সংগীতে অনুরাগী হয়ে ওঠেন। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনে তার ব্যত্যয় ঘটে। সংগীত সাধনার অভিপ্রায়ে বাড়ি থেকে পালিয়েও গিয়েছিলেন। ফলে পিতা সবদর হােসেন খাঁ পুত্রের সংগীত চর্চার ব্যবস্থা করে দেন। প্রথমত তিনি নিজেই তাকে সংগীতে তালিম দিতেন। আফতাব উদ্দিন খাঁ তবলা, বেহালা, বাশি প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্রে অসম্ভব পারদর্শী হয়ে উঠেন। তিনি ছিলেন এক সাধক। শিল্পী। লােকে তাকে ফকির (তাপস) আফতাবউদ্দিন নামে চিনত। বিখ্যাত ‘মলয়া’ সংগীতের অমর সুরকার ছিলেন। তিনি বহু প্রকার রাগ-রাগিনীতে সিদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন। একাধারে গীতিকার, সুরকার ও গায়ক ফকির আফতাব উদ্দিন ১৯৩৩ সালে পরলােক গমন করেন ।

সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ : বিশ্ববরেণ্য সংগীতজ্ঞ সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খা’র জন্ম ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে নবীনগরের শিবপুর গ্রামে। তার শৈশব কাটে মূলত এক সংগীত কাননে। ফলে সংগীতের স্বাভাবিক নেশা তাকে পেয়ে বসে শৈশবকালেই। প্রথম তালিম গ্রহণ করেন বড় ভাই সংগীত সাধক ফকির আফতাব উদ্দিন খা’র কাছে। কিন্তু সংগীতের জন্য তার অনন্ত তৃষিত আত্মা, সুরের অপার তৃষ্ণায় ধুকে ধুকে মরছিল যেন তাই যথাসময়ে তিনি বেরিয়ে পড়েন বিশ্ব সুরের সন্ধানে। বাংলার লােকজনপদে ঘুরে ঘুরে তিনি খুঁজে পান লােকসুরের ভাণ্ডার। তিনি কলকাতার বিখ্যাত সংগীত সাধক গােপাল কষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নননা গােপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি সাত বছর সরগম সাধনা করেন

পরবর্তীসময়ে তিনি যন্ত্রসংগীত চর্চা করেন। অমৃতলাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের কাছে। বশি, পিক্স, সেতার, মেন্ডােলিন, ব্যাঞ্জো প্রভৃতি যন্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। এরপর তিনি পাশ্চাত্য পদ্ধতি ও দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা বাদন রপ্ত করেন। এ ছাড়া সানাই, নাকাড়া, টিকাবাসহ সকল বাদ্যযন্ত্রেই দক্ষ হয়ে ওঠেন। আলাউদ্দিন খা ময়মনসিংহের মুক্তাগাছায় জমিদার বাড়িতে ওস্তাদ আহমদ আলী খা’র কাছে সুরের তালিম নেন। তা ছাড়া রামপুরের ওস্তাদ ওয়াজির খা’র কাছে সুরের তালিম নেন। তা ছাড়া ওস্তাদ ওয়াজির খা’র কাছে সরােদ শিক্ষা লাভ করেন। ওস্তাদ ওয়াজির খা’র কাছে তিনি সেনী ঘরানার গুরুত্বপূর্ণ সংগীত কৌশল চর্চা করেন । ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দের পরে আলাউদ্দিন খা মাইহারের রাজদরবারে সংগীত গুরুর আসন লাভ করেন। বিশ্ববিখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সঙ্গে তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হন ১৯৩৫ সালে । উপমহাদেশের সংগীত ঐতিহ্য ও বৈশিষ্ট্যকে তিনি বিশ্বসভায় তুলে ধরেন। ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৯৫২ সালে ‘সংগীত একাডেমী পুরস্কার, ১৯৫৮ সালে ‘পদ্মভূষণ পুরস্কার, ১৯৭১ সালে ‘পদ্মবিভূষণ’, ১৯৬১ সালে ‘বিশ্বভারতী প্রবর্তিত ‘দেশীকোত্তম’ খেতাব প্রাপ্ত হন। শান্তিনিকেতনে কিছুদিন অধ্যাপনাও করেন। তিনি অনেক বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবন এবং সরােদের আধুনিকায়ন করেন। সংগীতে বিশ্বখ্যাত ‘আলাউদ্দিন ঘরানার জনক ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ হেমন্ত, দূর্গেশ্বরী, মেঘ-বাহার, প্রভাতকেলিসহ অনেক রাগ-রাগিনীরও উদ্ভাবক ছিলেন। ১৯৭২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এই মহা সংগীত সাধক পরলােকগমন করেন।

ওস্তাত আয়েত আলী খাঁ : সদু খাঁ পরিবারের আরেক তারকা সন্তান ওস্তাদ আয়েত আলী খা’র জন্ম ২৬ এপ্রিল ১৮৮৪। জন্মস্থান শিবপুর গ্রাম। সংগীতে তারও প্রথম তালিম ঘটে তার বড় ভাই ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ’র কাছে। এরপর তিনি চলে যান ভারতের মাইহার রাজ্যে সেখানে তারই সহােদর ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতার ও সুরবাহারে সংগীত সাধনা করেন। ওস্তাদ ওয়াজির খা’র কাছে ১৩ বছর ব্যাপী গভীর মনােনিবেশের সঙ্গে সুরের তপস্যা করেন। কর্মজীবনে রামপুর রাজ্যের প্রধান সংগীতজ্ঞের পদে অধিষ্ঠিত হন। ১৯৩৫ সালে তিনি শান্তিনিকেতনে অধ্যাপক পদে যােগদান করেন। সেখান থেকেই অল্পকাল পরে তিনি নিজ জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং একটি সংগীত বিদ্যালয় ও বাদ্যযন্ত্র তৈরি করার জন্য একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লায় ‘আলাউদ্দিন মিউজিক কলেজ’ নামে দুটি উচ্চতর সংগীত চর্চা কেন্দ্র স্থাপন করেন। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ‘মনােহরা’ ও ‘মন্ত্রণাদন’ নামে তিনটি বাদ্যযন্ত্র এবং ‘বারিষ’, হেমন্তিকা’, ‘আওল চন্দ্রসারঙ্গ বসন্ত; ওমর-সােহাগ’ প্রভৃতি রাগ-রাগিনী উদ্ভাবন করেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬০ সালে গভর্নর পদক’, ১৯৭৬ সালে মরণােত্তর ‘শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার, ১৯৬১ সালে ‘তাঘমা-ই-ইমতিয়াজ’ খেতাব ও ১৯৬৬ সালে প্রাইড-অফ-পারফরমেন্স’ সম্মানে ভূষিত হন। ওস্তাদ আয়েত আলী খা’র চার পুত্র সংগীত জগতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তারা হলেন ওস্তাদ আবেদ হােসেন খান, ওস্তাদ বাহাদুর খান, মােবারক হােসেন খান ও শেখ সাদী খান। ২ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৭ এই মহান সংগীত সাধক কুমিল্লায় পরলােকগমন করেন।

 ওস্তাদ মােহাম্মদ হােসেন খসরু : সংগীতে অসামান্য কৃতিত্বের জন্যে সুর সমাট আলাউদ্দিন খাঁ কর্তক ‘দেশমণি’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি। এই দেশবরেণ্য সংগীততন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লার দারােগা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস কসবা উপজেলার মইনপুর গ্রামে। তার পিতা ছিলেন একজন বংশীবাদক। শৈশবে পিতার কাছেই বাঁশির তালিম গ্রহণ করেন। পরবর্তীকালে ওস্তাদ মেহেদী হাসান খা’র শিষ্যত। লাভ করেন। তার কাছে দীক্ষা নেন ধ্রুপদ, ধামার, সাদরা প্রভৃতি রাগসংগীতে। তিনি ওস্তাদ আবদুল করিম খাঁ এবং ওস্তাদ মঈজুদ্দিন খা’র কাছে ঠুমরী শেখেন। কর্মজীবনে অধ্যক্ষ ছাড়াও তিনি দেশি-বিদেশি সংগীত চর্চা কেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি প্রাইড-অব-পারফরমেন্স’, ১৯৭৮ সালে মরণােত্তর ‘শিল্পকলা একাডেমী পদক’ লাভ করেন। ১৯৫৯ সালে এই গুণী সংগীতসাধক পরলােকগমন করেন। | মনােনােহন দত্ত : মহর্ষি মনােমােহন দত্তের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার সাতমােড়া গ্রামের ১২৮৪ বঙ্গাব্দে। শৈশব থেকে তিনি ছিলেন ভাবুক প্রকৃতির এবং সংগীতানুরাগী। তাঁর পিতা পদ্মনাথ দত্তও ছিলেন সংগীতপ্রিয় লােক। কালীকচ্ছের শ্রী আনন্দস্বামী যে সর্বধর্ম সমন্বয়বাদের ধারণা প্রচার করছিলেন, সমকালীন সংগীতানুরাগী অনেকেই এর প্রতি আকৃষ্ট হয়। এর মধ্যে ফকির আফতাব উদ্দিন ও লবচন্দ্র ছিলেন। উল্লেখ্যযােগ্য। মনােমােহন দত্ত এদের নিয়েই তার নিজস্ব লােকধারার সংগীত ঘরানা গড়ে তুলেন। বৈষ্ণব ও বাউল ধারার যে সংগীত বাংলার লােকমানসকে আপ্লুত করেছিল মনােমােহন দত্ত সে ধারারই উল্লেখ্যযােগ্য ব্যক্তি। “মলয়া গানে জীবন ও জগতের গভীরভাবের সন্নিবেশ ঘটেছে। ১৩১৬ বঙ্গাব্দের ২০ আশ্বিন এই মহান সংগীতসাধক দেহত্যাগ করেন।

ওস্তাদ খাদেম হােসেন খা : শিবপুর সংগীত বলয়াবর্তের আরেক তারকা সন্তান ওস্তাদ খাদেম হােসেন খাঁ। জন্ম ১৯২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, পিতা নায়েব আলী খা, মাতার নাম-নিত্য খানম। সংগীতে প্রথম তালিম নেন পিতার কাছে। পরে ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁ ও আলাউদ্দিন খাঁর কাছে তবলা ও সেতার শিক্ষা করেন। ওস্তাদ আয়েত আলী খা’র কাছে তিনি সেতার ও ব্যাঞ্জ শিক্ষা করেন। ১৯৪৭ উত্তর পর্যায়ে তিনি ঢাকা রেডিওর সঙ্গে পুরােপুরি জড়িয়ে সংগীতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কারে ভূষিত হন। ১৯৯০ সালের ১০ ডিসেম্বর এই কৃতী সংগীতজ্ঞ পরলােকগমন করেন। | ওস্তাদ আলী আকবর খা : সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর পুত্র আলী আকবর খা। তিনি শৈশব থেকে সংগীত সাধনায় রত হন। সংগীত সাধনার প্রয়ােজনে ছুটে বেড়ান দেশ হতে দেশান্তরে। প্রায় চৌদ্দ বছর বয়সে তিনি এলাহাবাদের এক সংগীত সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে প্রশংসিত হন। বিশ্ববিখ্যাত বেহালাবাদক মেনুহীনের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের নিউয়র্কের আর্ট মিউজিয়াম হলে সংগীত পরিবেশন করে অভূতপূর্ব প্রশংসা অর্জন করেন। তিনি বিশ্ব সফরের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সংগীত পরিবেশন। করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকগিল ও মন্ট্রিল বিশ্ববিদ্যালয় সংগীতের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব। পালন করেন। পন্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে সেতার ও সরোদের দ্বৈত পরিবেশনে খ্যাতি  লাভ করেন। সংগীতের জন্য বহু সম্মান ও সম্মাননা তিনি লাভ করেছেন। এর মধ্যে। ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার ও পদ্মভূষণ খেতাব উল্লেখ্যযােগ্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডিগ্রি প্রদান করে। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ সংগীতের কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাগ ও তাল সৃষ্টি করেন। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর পুত্র। আশিষ খা ও ধ্যানেশ খাঁ সংগীত জগতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন।

ওস্তাদ ফুলঝুরি খান : ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর দৌহিত্র ফুলঝুরি খানের জন্য। ১৯২০ সালে নবীনগরের বিটঘর গ্রামে। তার পিতার নাম লতিফ রসুল খান। শৈশবে তার নাম ছিল ইয়ার রসুল খান। ফকির আফতাব উদ্দিন খাঁর কাছেই তিনি প্রথম যন্ত্র। সংগীতে দীক্ষা লাভ করেন। পরে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এবং ওস্তাদ আলাউদ্দিন খার কাছে সংগীতে তালিম নেন। তাঁর তবলা বাদনে মুগ্ধ হয়ে মাইহারের নবাব তাঁকে। ফুলঝুরি উপাধিতে ভূষিত করেন। এরপর থেকে তিনি ফুলঝুরি খান নামে সমধিক পরিচিত লাভ করেন। উদয় শঙ্করের নৃত্যদলে তিনিও সংগীতশিল্পী হিসেবে বিশ্বভ্রমণ করেন। তিনি যন্ত্রসংগীতের শিক্ষকরূপে শান্তিনিকেতনে কাজ করেন। ১৯৫১ সালে তিনি ভারত থেকে দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বেতারে যােগদান করেন। সংগীতে কৃতিত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তাঁকে ১৯৮৭ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৮২ সালে এই মহান সংগীতসাধক পরলােকগমন করেন।

লােক শিল্পী দুলামিয়া : লােকসংগীত প্রণেতা ও শিল্পী দুলামিয়া মাস্টারের জন্ম ১৮৬৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের গজারিয়া গ্রামে। তার লােকসংগীতগুলাে তৎকালীন যুগে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মুর্শিদি, মারফতি ও রাজনৈতিক গানসহ তিনি বিপুল পরিমাণ গানের রচয়িতা। তিনি তার সংগীত পরিবেশনের জন্য যে, শিল্পীগােষ্ঠী গড়ে তােলেন সে দলে পৈলন খাঁ, রমনী বৈদ্য, আরমান আলী, হাসু মিয়া প্রমুখ জড়িত ছিলেন।

ওস্তাদ মােহাম্মদ হােসেন খান : ওস্তাদ আলী আহমদ খা’র পুত্র মােহাম্মদ হােসেন খান আজীবন সংগীত নিয়েই সাধনা করেছেন। শৈশবে পিতার কাছে তালিম নিয়ে পরে ওস্তাদ মােহাম্মদ হােসেন খসরুর কাছে কণ্ঠসংগীত শিক্ষালাভ করেন। তিনি বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী এবং ঢাকার সংগীত কলেজে অধ্যাপনা করেন। ওস্তাদ মােহাম্মদ হােসেন খান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, হংকং রেঙ্গুন ও আফগানিস্তান সফর করেন। তাঁর জন্ম ২৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ সালে তিতিয়া রঘুনাথপুর গ্রামে। তিনি ঢাকায় পরলােকগমন করেন ।

অমর পাল : খ্যাতিমান লােকসংগীত শিল্পী অমর পাল ছিলেন আকাশবাণীর নিজস্ব শিল্পী। লােকসংগীতের এক অনুরক্ত সাধক অমরপালের জন্ম ১৯২২ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ কাছে রাগসংগীতে দীক্ষা নেন। লােকসংগীত শেখেন তার পিতা ও মাতার কাছে। সত্যজিৎ রায়ের ছবিতে তিনি লােকধারার সংগীত পরিবেশন করে খ্যাতি লাভ করেন।

রওশন আরা বেগম (অন্নপূর্ণা) : সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা রওশন আরা বেগম সংগীতে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। শৈশবেই তিনি পিতার কাছে তালিম নেন। আলাউদ্দিন খাঁ কন্যাকে ধ্রুপদ ধারার যন্ত্র সুরবাহারে দীক্ষিত করে তােলেন। অন্নপূর্ণা সুরবাহারে এমনই সুর সৃষ্টি করতে পারতেন, যা শােনে পিতাও অভিভত হতেন। | ওস্তাদ আবেদ হােসেন খান : অধ্যবসায়ী সংগীত সাধক আবেদ হােসেন খানের জন্ম ১ এপ্রিল ১৯২৮ সালে শিবপুর গ্রামে। তার পিতা সংগীত সাধক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ও মাতা ওমর-উন নেসা। ১৯৫০ সাল থেকে তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রে নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কাজ করেন। সুরকার হিসেবে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি সংগীত কলেজে সংগীতের তত্ত্বীয় বিষয়ে শিক্ষাদান করেন। সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে তিনি সুইজারল্যান্ড, ভারতসহ বহুদেশ সফর করেন। তিনি নদী ও নারীসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন। তিনি ১৯৮৫ সালে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘একুশে পদক লাভ করেন।

ওস্তাদ মীর কাশেম খান : শিবপুর সংগীত ঘরানার কৃতী সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ মীর কাশেম খান। জন্ম শিবপুরে ১৯২৮ সালে। শৈশবকালেই সংগীতের সঙ্গে জড়িয়ে। পড়েন। পিতা নায়েব আলী খাঁর কাছে সংগীতে তাল ও যন্ত্রসংগীতে হাতেখড়ি ঘটে। শিবপুর থেকে মাইহারে গিয়ে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সংগীতে দীক্ষা লাভ করেন। সেতারে তার দক্ষতার খ্যাতি সর্বমহলে প্রশংসিত হয়। তিনি ঢাকা বেতারের একজন নিজস্ব শিল্পী ছিলেন। সাংস্কৃতিক দলের সদস্য হিসেবে তিনি বিভিন্ন দেশ সফর করেন। সংগীত পরিচালক ও সুরকার হিসেবেও তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের শ্রেষ্ঠ সেতারবাদক পুরস্কার, শিল্পকলা একাডেমী স্বর্ণপদক’ এবং কৃতীসন্তান হিসেবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংবর্ধিত হন। সংগীতে বিশেষ অবদানের জন্য ১৯৮৪ সালে তিনি একুশে পদকও লাভ করেন। ১৯৮৪ সালের ১১ ডিসেম্বর এই খ্যাতিমান সংগীতজ্ঞ প্রয়াত হন।

ওস্তাদ বাহাদুর হােসেন খান : অনন্য সরােদ শিল্পী বাহাদুর হােসেন খানের জন্ম ১৯৩১ সালে নবীনগরের শিবপুর গ্রামে। পিতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, মাতার নাম ওমর-উন-নেসা। অতি শৈশবেই সংগীতে তালিম লাভ করেন তিনি। পিতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এবং চাচা সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সরােদে দীক্ষা নেন। বিশ বছরব্যাপী সাধনায় তিনি সরােদে এক গুণী শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে তিনি চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ইউরােপের কিছু দেশ সফর করেন। ১৯৮৯ সালের ৩ অক্টোবর তিনি পরলােকগমন করেন।

মােবারক হােসেন খান : বাংলা সংগীত লিটারেচারের অনন্য তাত্ত্বিক ও আলােচক মােবারক হােসেন খান। তাঁর জন্ম ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। তার পিতা সংগীত মনীষী ওস্তাদ আয়েত আলী খা এবং মায়ের নাম ওমর-উন নেসা। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারায় তিনিও শৈশবেই সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হন। শৈশবেই তিনি বেহালা, চন্দ্রসারং, মন্দ্রানাদ ও সুরবাহারে দক্ষ হয়ে উঠেন। মােবারক হােসেন। খানের অন্যরকম কৃতিত্ব হচ্ছে সংগীতবিষয়ক তাঁর গ্রন্থাবলি। সাহিত্যের অনুবাদের জন্যও তিনি প্রশংসিত হয়েছেন। সংগীতে অবদানের কারণে তিনি অনেক সম্মাননা এবং পদক লাভ করেছেন ।

আফজালুর রহমান : সরােদ ও বেহালায় এক গুণী বাদক আফজালুর রহমান। শৈশবে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে তিনি সংগীতের প্রতি একান্ত চিত্তে ঝুঁকে পড়েন। তিনি হেমন্ত কুমার রায়, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খা’র কাছে সংগীত শিক্ষা করেন। রেডিও, টেলিভিশনেও তিনি সংগীত পরিবেশন করেছেন। সংগীতের জন্য তিনি বহুভাবে মূল্যায়িত হয়েছে ।

ওস্তাদ খুরশিদ খান : সেতারের খ্যাতিমান শিল্পী ওস্তাদ খুরশিদ খান ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁর দৌহিত্র । তিনি তার মামা আবেদ হােসেন খান, বাহাদুর হােসেন খানের কাছে সেতার শিক্ষা লাভ করেন। সংগীতে শিক্ষকতা করেছেন এবং ১৯৬১ সাল থেকে রেডিওতে নিয়মিতভাবেই সেতার পরিবেশ করেছেন। সংগীতের জন্য প্রশংসিত হয়েছেন।

শেখ সাদী খান : শিবপুরের খ পরিবারের আরেক শিল্পী শেখসাদী খান । বাংলাদেশের সংগীত জগতে তাঁর সুনাম সুবিদিত। শৈশবে পারিবারিক পরিবেশেই সংগীতের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পিতা আয়েত আলী খাঁর কাছে প্রথম তালিম গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের অনেক জনপ্রিয় গানে তিনি সুরারােপ করেছেন। শুধু সুরকার হিসেবে নয় সংগীত পরিচালনা এবং একজন সংগীত রচয়িতারূপেও শেখসাদী খান অনন্য অবদান রেখেছেন। বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে শেখসাদী খানের নাম ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত।

সৈয়দ আবদুল হাদী : বাংলাদেশের অন্যতম সংগীত শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী কসবা উপজেলার শাহপুর গ্রামে ১৯৪০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে চলচ্চিত্রে সংগীত পরিবেশন করেন। জন্ম থেকে জ্বলছি মাগাে ও আছেন আমার মােক্তার, আছেন আমার ব্যারিস্টার’ প্রভৃতি জনপ্রিয় গান আবদুল হাদী গেয়েছেন। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি বহু পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।

ওস্তাদ আলী আহমদ খান : প্রখ্যাত সেতার বাদক আলী আহমদ খাঁর জন্ম। নবীনগরের শ্রীরামপুরে। তার পিতা গুল মােহাম্মদ খা-ও একজন গুণী সেতারবাদক ছিলেন। কর্মজীবনে তিনি কলকাতা বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন।

ইরশাদ আলী খান : জন্ম নবীনগরের শিবপুর গ্রামে ১৩১৫ বঙ্গাব্দে। মূলত একজন সেতার বাদক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। তার পুত্র মতিউল হক খান বাংলাদেশের অন্যতম সেরা সেতারবাদক এবং বাংলাদেশ বেতারের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে কর্মরত।

ইসরাইল খা : একজন গুণী এসরাজ বাদক ইসরাইল খাঁর জন্ম ১৮৯৭ সালে কসবার ডাবিরঘর গ্রামে। তিনি আলাউদ্দিন খাঁ ঘরানার একজন খ্যাতিমান শিল্পী। কর্মজীবনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনি একটি বাদ্যযন্ত্র কারখানা চালু করেন। নিজে বাদ্যযন্ত্র তৈরিতে খুবই দক্ষ ছিলেন ।

বজলুল করিম : তবলাবাদক হিসেবে বজলুল করিম খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মূলত তিনি কলকাতায় সংগীত সাধনা করেন। ১৯৪৭ পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত হন। বজলুল করিম ১৯১৮ সালে নবীনগরের শ্রীরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

শবচন্দ্র পাল : সংগীতজ্ঞ লচন্দ্র পালের জন্ম দেবীদ্বারে । নবীনগর উপজেলার ভােলাচং ও সর্বধর্ম মিশন স্থাপন করেন । তিনি মনােমােহন দত্তের একজন সঙ্গী হিসেবে সংগীত সাধনা করেন। বেশ কিছু গ্রন্থের তিনি প্রণেতা ।

সুরেন চক্রবর্তী : কলকাতার জনপ্রিয় শিল্পী সুরেন চক্রবর্তীর জন্য কসবা উপজেলায়। মূলত তিনি ছিলেন জনপ্রিয় লােকসংগীত শিল্পী। কলকাতা বেতারে নিজস্বশিল্পী হিসেবে কাজ করেন । তিনি চলচ্চিত্রেরও জনপ্রিয় শিল্পী ছিলেন ।

ভুবন রায় : বিশিষ্ট সংগীত রচয়িতা ভুবন রায়ের জন্ম ১৮৩৪ সালে নবীনগরের শ্যাম গ্রামে। খ্যাতিমান গীতিকার ও শিল্পী ছিলেন তিনি। সংগীতবিষয়ে নয়টি গ্রন্থ তিনি রচনা করেছেন। ১৮৮৯ সালে তিনি পরলােকগমন করেন।

অজয় ভট্টাচার্য : সৃজনশীল কবি ও গীতিকার অজয় ভট্টাচার্যের জন্য নবীনগরের শ্যামগ্রামে। সংগীত রচয়িতা ও সুরকার হিসেবে তিনি ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি বহু সংগীতবিষয়ক গ্রন্থের রচয়িতা।

গজেন্দ্রলাল রায় : ওস্তাদ গজেন্দ্রলাল রায়ের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় । তিনি সংগীত সাধনায় প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন সংগীত শিক্ষক।

উমেশচন্দ্র রায় : সংগীত গুরু উমেশচন্দ্র রায়ের জন্ম ১৯১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মজলিশপুর গ্রামে। তিনি শচীনদের বর্মণের কাছে দীর্ঘদিন সংগীত সাধনা করেন। তিনি ছিলেন আলাউদ্দিন সংগীতাঙ্গনের প্রাক্তন অধ্যক্ষ।

একেএম হারুনুর রশীদ : খ্যাতিমান কবি ও শিক্ষাবিদ এ কে এম হারুনুর রশীদ সংগীত রচনা করে প্রশংসিত হয়েছেন। তিনি একজন শিল্পী হিসেবেও সুপরিচিত। জন্ম কসবা উপজেলার খাড়েরা গ্রামে।

প্রীতি চক্রবর্তী ও স্মৃতি চক্রবর্তী : জন্ম তাদের শিলাউর গ্রামে। গুণী নৃত্যশিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি লাভ করেন। প্রীতি চক্রবর্তী উদয় শঙ্করের নৃত্যদলেরও সদস্য ছিলেন ।

ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম : উপমহাদেশ খ্যাত বংশীবাদক ক্যাপ্টেন আজিজুল ইসলাম । পৈত্রিক নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ভাতশালা গ্রামে। বাঁশিতে তালিম নেন। চট্টগ্রামের একটি আর্যসংগীত প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন গুণী সংগীতজ্ঞের সান্নিধ্যে আসেন।

মুহাম্মদ মুজাকের : বিশিষ্ট গীতিকার মুহাম্মদ মুজাক্কের ১৯৪৪ সালের ১৫ জুলাই বাঞ্ছারামপুরের উলুকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সংগীত রচনা করে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছেন। তার বহু গান জনপ্রিয়তা লাভ করেছে ।

আশীষ খান : ধ্রুপদী সংগীতের একজন গুণী শিল্পী আশীষ খান। শৈশব থেকেই সংগীতে কঠোর তপস্যা করেন। পারিবারিক পরিবেশে সংগীতে প্রভূত দক্ষতা অর্জন করেন। বিশেষ করে সরােদ বাদনে তার খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। তিনি কিছুদিন যুক্তরাষ্ট্রের আলী আকবর কলেজ অব মিউজিকে অধ্যাপনা করেন।

ধ্যানেশ খান : সংগীতের গুণী শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খার ২য় পুত্র ধ্যানেশ খান। শুরুতে তালিম নেন পিতামহ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। সরােদের তিনি একজন খ্যাতিমান শিল্পী। সংগীত বিষয়ে কলকাতায় শিক্ষকতা করেছেন ।

রাজা হােসেন খান : ১৯৩৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে জন্ম । খ্যাতিমান বেহাল বাদক। প্রথম তালিম গ্রহণ পিতা নায়েব আলী খাঁর কাছে। সরােদ বাদনেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। রাজা হােসেন খান একজন গুণী সংগীত পরিচালক ও সুরকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন । ১৯৮৯ সালের ৩ মার্চ তিনি পরলােকগমন করেন।

মমতা খানম : বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মমতা খানমের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। পিতা আয়েত আলী খাঁর কাছে সংগীতে শিক্ষা দেন। নজরুল গীতি ও আধুনিক গান ছাড়াও রাণ প্রধান গানে পারদর্শিতা অর্জন করেন। কর্মজীবনে শিক্ষকতা করেছেন!

সুবল দাস : খ্যাতিমান সংগীত পরিচালক। জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে। শুরুতে যন্ত্রসংগীত নিয়ে সাধনা শুরু করেন । সেতার ও তবলায় তিনি বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছেন। চলচ্চিত্রে ও বেতার-টিভিতে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। সংগীতের জন্য বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত হয়েছেন।

বিলাস খান : সেতার শিল্পী বিলাস খান বাংলাদেশ বেতারের একজন নিজস্ব শিল্পী। তার পিতা ওস্তাদ মীর কাশেম খান। তাঁর জন্ম ১৯৬৮ সালে।। | সন্ধ্যা রায় : স্বামী যতীন্দ্রচন্দ্র সাহা, পাইকপাড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ও সংগীত প্রশিক্ষক। কীর্তন, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, মলয়া, আধুনিক ও আঞ্চলিক গানে বিশেষ পারদর্শী। ১৯৪৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।

ফিরােজ আহমেদ : গত শতাব্দির চল্লিশের দশকে জন্ম। পিতা : আবদুর রশিদ, মাতা : আইমন নেছা, গ্রাম : পৈরতলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। বাল্যকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত সুরকার মিলন সেনের কাছে সংগীতে হাতেখড়ি। পর্যায়ক্রমে ওস্তাদ আদিল হােসেন চান মিয়া, ওস্তাদ অশ্বিনী রায়, ওস্তাদ উমেশচন্দ্র রায় প্রমুখের কাছে সংগীতে তালিম গ্রহণ করেন । লােকসংগীত, মলয়া সংগীত এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আঞ্চলিক গানে তিনি বিশেষ পারদর্শী। উত্তাল ষাটের দশক, উনসত্তরের গণআন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি গণসংগীত ও দেশেরগান গেয়েছেন। তিনি মুক্তিযােদ্ধা। পূর্ব রণাঙ্গনে গান গেয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন ।