পুতুল নাচের সূত্রপাত এবং ইতিহাস

পুতুল নাচের সূত্রপাত এবং ইতিহাস
ভাটি বাংলার ঐতিহ্যবাহী জনপদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া । আদিকাল থেকেই এখানে নানা রকম সংস্কৃতিচর্চা লক্ষ করা যায় । বিশেষত লােকায়ত সংস্কৃতিচর্চা এখানকার মানুষদের একটি প্রধান ঐতিহ্য । এখানকার গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন গানের দলের ইতিহাস খুজে পাওয়া যায় । এরই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে যাত্রা – অপেরা , সার্কাস ও পুতুলনাচ । এ সব ক্ষেত্রেই পাওয়া যায় বিভিন্ন পেশাদারি দল । বিশেষত বিভিন্ন পূজা – পার্বণ , মেলা – বান্নিতে তারা বিনােদন প্রদর্শন করত । এদেশে জমিদারি প্রথা চালু হওয়ার পর থেকে এই প্রান্তিক সংস্কৃতিচর্চার শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচের ক্ষেত্রেও তা লক্ষ করা যায়।

পুতুলনাচের সূতপাত এবং প্রবর্তন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচের সূত্রপাত কবে তা হয়তাে নির্ধারণ করা সম্ভবপর নয়। অনেক বিষয়ের মতাে কালের পরিক্রমায় তা ঢাকা পড়ে গেছে । যতটুকু জানা যায় , নবীনগর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের বিপিন পাল প্রথম এ অঞ্চলে পুতুলনাচের প্রবর্তন করেন । এই কৃষ্ণনগরেই রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী একটি জমিদার বাড়ি । বিপিন পাল শুরুতেই তাদের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করেন । বিভিন্ন সূত্রে জানা যায় , বিপিন পালের দলের নাম ছিল গােবিন্দ পুতুলনাচ ‘ । গােবিন্দ ছিল বিপিন পালের ছেলের নাম । বিপিন পাল বিভিন্ন পূজা – পার্বণে ‘ পুতুল নাচের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মীয় পালা পরিবেশন করতেন । দেশভাগের কিছুদিন পর বিপিন পাল মারা গেলে তার পুত্র গােবিন্দ পাল । সপরিবারে দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান । তাদের অনুপস্থিতিতে দল মারাত্মক সংকটে পড়ে । এ সময়ে দলের হাল ধরেন গিরিশ আচার্য ।

পরবর্তীকালে তার হাত ধরেই এদেশের পুতুলনাচের একটি নতুন ধারার সৃষ্টি হয় । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত পুতুল নাট্যশিল্পী ধন মিয়া এ দলের সদস্য হিসেবে পুতুলনাচকে রপ্ত করেন । ধন মিয়া শৈশবে সার্কাস দলেও কাজ করেন । পরবর্তীকালে তিনি পুতুল । নাট্যদলের দিকে ঝুঁকে পড়েন । (১৯৫৫ – ৫৬) সালের দিকে তিনি গিরিশ আচার্যের দলে কাজ করা শুরু করেন । অল্পকাল পরে গিরিশ আচার্যও দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান । দলের হাল ধরেন দলের সদস্য ডেঙ্গু মাঝি । ধন মিয়া এই দলেরও সদস্য হিসাবে কাজ করেন । এ সময়ে গিরিশ আচার্যের দলের সদস্য তালশহর গ্রামের কালু মিয়া স্বতন্ত্র একটি দল গঠন করেন । কালু মিয়া ও ধন মিয়া পুতুলনাচের প্রথম পর্যায়ের মুসলমান শিল্পী ।

পুতুলনাচে এরা অত্যন্ত খ্যাতিও অর্জন করেন । কালু মিয়ার দলে কাজ করতেন ধন মিয়ার চাচা তারা মিয়া । পুতুল নাচিয়ে হিসেবে যার রয়েছে অনেক খ্যাতি । এই তারা মিয়া স্বতন্ত্র দল গঠন করেন , যার নাম ছিল ‘ ঝুমুর পুতুলনাচ ‘। ধন মিয়া এই দলের একজন দক্ষ পুতুল নাচিয়ে হিসেবে আবির্ভূত হন । এ দলের অন্যান্য সদসবাে । হলেন রাজু মিয়া ও হােসেন আলী । ব্রাহ্মণবাড়িয়া তথা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এ দলটি দীর্ঘদিন পুতুলনাচ পরিবেশন করে । এ দলের মাধ্যমেই পুতুলনাচের খ্যাতি নতুনভাবে ছড়িয়ে পড়ে । স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত ‘ ঝুমুর পুতুলনাচের ’ সুনাম ও সমৃদ্ধি লক্ষ করা যায় । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রখ্যাত লেখক , গবেষক অধ্যক্ষ মিন্নাত আলী তার তিতাস পাড়ের ব্রাহ্মণবাড়িয়া স্মৃতিকথায় । ১৯৬৩ সালের এসডিও মেলার কথা উল্লেখ করেছেন । সে মেলায় বিপুল জনপ্রিয় পুতুলনাচ প্রদর্শিত হয় । মানুষ টিকেট কেটে সে পুতুলনাচ দেখে । তা ছাড়া বৈশাখি মেলা , আঞ্চলিক মেলা ও বান্নিতে পুতুলনাচ ছিল তখন আবশ্যক । বিভিন্ন জাতীয় দিবসেও পুতুলনাচ প্রদর্শিত হতাে । ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পুতুলনাচের একটি নতুন স্বর্ণযুগের সূত্রপাত ঘটে । অভিজ্ঞ পুতুলনাচ শিল্পী ধন মিয়া গঠন করেন “ রয়েল বীণা পুতুলনাচ ’ যুদ্ধের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে তিনি পুতুলনাচ প্রদর্শন করেন । তিনি ১৯৭৪ সালে । ঢাকা সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় নিজস্ব প্যান্ডেলে । মাসব্যাপী পুতুলনাচ প্রদর্শন করেন । এর ফলে তার দলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী । এ সময়ে তিনি প্রখ্যাত আর্টিস্ট ও পাপেট শিল্পী মােস্তফা মনােয়ারের সাথে পরিচিত হন । শিল্পী মােস্তফা মনােয়ারের সহায়তায় ধন মিয়া বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে । পুতুলনাচ পরিবেশন করে ব্যাপক খ্যাতি লাভ করেন । পরবর্তীকালে তিনি ভারত , রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পুতুলনাচ প্রদর্শনের সুযােগ লাভ করেন এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুল নাচকে এনে দেন আন্তর্জাতিক খ্যাতি। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর সারা দেশেই শুরু হয় মাসব্যাপী যাত্রা ও মেলা । সেগুলােতে বেড়ে যায় পুতুলনাচের চাহিদাও । এ সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গঠিত হয় একাধিক পুতুল নাচ দল । তারা মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া পিতার ‘ ঝুমুর পুতুলনাচ ‘ কে পুনরুজ্জীবিত করেন । ধন মিয়ার এক সহকর্মী নান্টু মিয়া গঠন করেন ‘ উজালা বীণা পুতুলনাচ ’ । হােসেন আলী ও তার পুত্র ফুল মিয়া গঠন করেন বীণা বীণা পুতুলনাচ ‘।পরবর্তীকালে এ দলের কাণ্ডারি হন প্রখ্যাত পুতুলনাচ শিল্পী খেলু মিয়া । পুতুলনাচ শিল্পী মােঃঃ সিদ্দিক মিয়া গঠন করেন ‘ ঝুমুর বীণা পুতুল নাচ । স্বাধীনতার পরবর্তীকালে এ দলগুলাে পুতুলনাচকে একটি স্থানীয় ঐতিহ্যের ধারায় অধিষ্ঠিত করেন । এ সকল ঐতিহ্যকে বিবেচনা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে বলা হয় পুতুলনাচের প্রাণকেন্দ্র । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচ দীর্ঘ সময়ে একটি স্বতন্ত্র ধারাও অর্জন করে । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচ চর্চা ধারাক্রমকে নিম্নোক্ত ছকে প্রকাশ করা যায় ।

পুতুল ও তার কারিগর
পুতুলনাচের প্রধান উপকরণ হচ্ছে নাচের পুতুল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনৃত্যে প্রথম দিকে কৃষ্ণনগরের কুমারদের তৈরি পুতুল ব্যবহৃত হতাে । কিন্তু বিংশ শতকের ষাটের দশকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বিভিন্ন শিল্পীরা পুতুল তৈরির কাজটি করতে থাকে । এর মধ্যে শহরের শিমরাইলকান্দির কারিগররাই প্রধান । পুতুল তৈরির কারিগরদের বলা হয় ‘ আচার্য ’ বর্তমানে পুতুল তৈরির কাজ করেন কান্দিপাড়ার চান্দু আচার্য । এ কাজে তার অভিজ্ঞতা দীর্ঘ। তিনি মূলত অর্ডার নিয়ে পুতুল তৈরি করে দেন। বর্তমানে পুতুল তৈরির উপকরণ হচ্ছে এঁটেল মাটি , খড় ও শােলা । এসব উপকরণ দ্বারা পুতুল তৈরি করে পুতুলে রঙ করা হয় , চুল ও কাপড় পরানাে হয় । পুতুল দুই ধরনের হয় – মানুষ ও জীব – জন্তু। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিভিন্ন দলের পুতুলের মধ্যে বেশ মিল আছে । পুতুলের ধরনেও তেমন পার্থক্য নেই ।

সাম্প্রতিক পুতুলনাচ
সম্প্রতি পুতুলনাচ নানা সংকটের মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছে । দিন দিন পুতুলনাচের চাহিদা কমে যাচ্ছে । আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে এ শিল্প থেকে অনেকে সরে যাচ্ছে । প্রখ্যাত পুতুলনাচ শিল্পী ধন মিয়ার ছেলে শামীম মিয়া ‘ রয়েল বীণা পুতুলনাচ ’ দল পরিচালনা করছেন । তিনি জানালেন নানামুখী আর্থিক সংকটের কারণে এ শিল্প হুমকির সম্মুখীন । । এখন আগের মতাে একনিষ্ঠ কলা – কুশলীদেরও অভাব । অনেকে পুতুলনাচে গুণগত পরিবর্তন না আসাকেও এর একটি অন্যতম সংকট মনে করেন । প্রায় শত বছর ধরে এখানকার পুতুলনাচ একটি বৃত্তের মধ্যেই আবর্তিত হচ্ছে । প্রখ্যাত পুতুলনাচ শিল্পী তারা মিয়ার ছেলে রাজু মিয়া পিতার ‘ ঝুমুর পুতুলনাচ ‘ কে পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন । ধন মিয়ার ‘ রয়েল বীণা পুতুল নাচ ’ র পাশাপাশি এ দলটিও খ্যাতি অর্জন করেছিল । কিন্তু রাজু মিয়ার মৃত্যুর পর এ দলটি প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ।

আর্থিক অস্বচ্ছলতার কারণে তার ছেলেরা বিভিন্ন পেশায় জড়িয়ে পড়ে । পুতুলনাচের শিল্পী তারা মিয়ার দলে ছিলেন হােসেন আলী। তিনি দলে সানাই বাজাতেন । হােসেন আলীর ছেলে ফুল মিয়া ও খেলু মিয়া । পিতার মতাে পুতুলনাচের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন । এ পেশায় রয়েছে তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাও । তাদের দলের নাম ‘ বীণা বীণা পুতুল নাচ ’ । ফুল মিয়ার মৃত্যুর পর খেলু মিয়া এখনাে বীণা বীণা পুতুলনাচ ‘ দলটি চালাচ্ছেন । তিনিও পুতুলনাচ শিল্পের নানা সমস্যার কথা জানালেন । সুস্থ বিনােদন মাধ্যম হিসেবে পুতুলনাচ এখনাে টিকে আছে । বিভিন্ন মেলা – বান্নিতে পতলনাচ বেশ মাতিয়ে তােলে । বর্তমানে বাণিজ্যিক কাজেও পুতুলনাচের ব্যবহার বেড়ে চলেছে । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচ এখন সারা দেশে পরিচিত । বিশেষ করে বৈশাখি উৎসবগুলােতে পুতুলনাচের চাহিদা বেড়ে যায় ।

তবে পুতুলনাচ আগের জনপ্রিয়তা আর ফিরে পাচ্ছে না , এমনটিই ধারণা এর সাথে সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলীদের । ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পরিচিত একটি দল হচ্ছে ‘ চন্দ্রিমা পুতুলনাচ ‘ । এর পরিচালক হচ্ছে শরীফুল ইসলাম মালদার । জীবনযাত্রার পরিবর্তনের কারণেই পুতুলনাচ হুমকিতে আছে । পুতুলনাচের ইতিহাস সম্পর্কে যতদূর জানা যায় , বিপিন পাল প্রথম পুতুলনাচ প্রবর্তন করেন । ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর থানার কৃষ্ণনগরে বিপিন পালের জন্ম । বিপিন পাল তখনকার সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পৌরাণিক কাহিনি । অবলম্বন করে পুতুলনাচ করতেন বলে জানা যায় । কৃষ্ণনগর গ্রামের আর একজন পুতুল নাচিয়ের নাম গিরিশ আচার্য । পুতুলনাচের জনপ্রিয়তায় বিপিন পালের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও কয়েকটি পুতুলনাচের দল তৈরি হয়েছিল । মােঃ তারু মিয়া পুতলনাচের ক্ষেত্রে পথিকৃৎ ব্যক্তি ছিলেন । তেমনই গিরিশ আচার্যের দলে কাজ করতেন শহরের মেডড়া বা মেরুড়া এলাকার ধন মিয়া । তারু মিয়ার পর কালু মিয়া , মৃত খুরশিদ মিয়া ও মােঃ রাজ হােসেন পুতুলনাচকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জনপ্রিয় করে তােলেন । এদের সম্মিলিত প্রচেষ্ঠার মাধ্যমেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুতুলনাচ দেশে – বিদেশে প্রচুর সুনাম অর্জন । করতে সমর্থ হয় । ধন মিয়ার দলের নাম রায়ের বীণা অপেরা । সম্প্রতি অন্য একটি দলকে পুতুলনাচ প্রদর্শনে দেখা যাচ্ছে । দলটির নাম ‘ সুমী বীণা পুতুলনাচ ’ দল ও ঝুমুর পুতুল নাচ দল ।