একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথা

একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথা তার নিজেস্ব ফেইসবুক আইডি থেকে নেওয়া। নবীন নগর উপজেলার বীর গাও গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসুল আরেফিন খান ১৯৭১ সালে যুদ্ধের কিছু স্মৃতি শেয়ার করেছেন

—————————-গেরিলা ৭১————————–

বঙ্গব্ন্ধুর ৭ মার্চের ভাষন ছিল পাকিস্তানকে চুরান্ত বার্তা,বাঙ্গালীর স্বাধীনতার ঘোষনা।২৫ মার্চ পাকিস্তানী বর্বর বাহিনী ঘুমন্ত বাঙ্গালীর উপর ঝাপিয়ে পরলে জেগে ওঠে গ্রাম।শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। তখন বঙ্গবন্ধুর বন্দি প্রসংগে ধুম্রজাল সৃষ্টি হলেও বঙ্গবন্ধুই ছিল শক্তির মূল উৎস।প্রবাসী সরকার গঠনের আগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত ভাবে যুদ্ধ চলতে থাকে।প্রবাসী সরকার গঠন ও ১১ টি সেক্টর বিভক্তি মুক্তিযুদ্ধকে প্রচন্ড গতিশীল করে তুলে।আমি শ্রদ্ধা ভরে স্বরন করি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে।

বাংলার স্বাধীনতার উজ্জল নক্ষত্র। কামনা করি স্বর্গই হওক ওনার ঠিকানা।
বীরগাঁও একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ গ্রাম।সিংহ পুরুষ দারু মিয়া সাহেবের রংমহল হয়ে উঠে মুক্তিযুদ্ধের ঘাটি। দারু মিয়া সাহেবের ছোট ছেলে এনায়েত উল্লাহ খান(সরু ভাই) তখন ঢাকা বিশ্ববাদ্যালয়ের ইকবাল হলের ছাত্র। আমার আরেক শ্রদ্ধেয় বড় ভাই আ,স,ম জহিরুল হুদা জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি।আমাদের সাথে আরো একজন এসে যোগদান করেন লালপুরের জয়নাল ভাই।তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ভিপি ছিলেন এবং আরো অনেকে চলার পথে স্বরনার্থী মুক্তিযুদ্ধাদের জন্য এটা ছিল একটা নির্ভরযোগ্য ঘাটি।জুন মাসের দিকে আবদুল মালেক খান, মোহাম্মদ আলী,ছৈয়দ হুসেন মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিয়ে অস্ত্র সহ দেশে ফিরে আসে।আগষ্ট মাসের প্রথম দিকে হঠাৎ ফটিক রাজাকারের নেতৃত্বে গ্রামে রাজাকার প্রবেশ করে।মুক্তিযুদ্ধারা ফটিক রাজাকার সহ দুই রাজাকারকে গ্রেফতার করে। আমরা সহযোদ্ধা ছিলাম।চলে এলাম ত্রিপুরায়। হাফানিয়া নামক স্থানে তিতাস ক্যাম্পে অবস্থান করি।

কাজী আকবর উদ্দীন সিদ্দিক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আমাদের ক্যাম্প প্রধান ছিল। সাধারন ভাবেই নবীনগর,কসবার ছেলেরাই এখানে ছিল।আধা কিঃমি দূরে ছিল বঙ্গবন্ধু ক্যাম্প। ক্যাম্প প্রধান ছিল দেওয়ান আবুল আব্বাস জাতীয় পরিষদ সদস্য।ক্যাম্পে মাঝে মাঝে অনুষ্ঠান হত।আবার নাটকীয় ঘটনাও ঘটত।এক রাতে কসবার ছেলেরা ক্যাম্পে ১৪৪ ধারা জারি করে উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্যাম্প প্রধান কাজী আকবর উদ্দীন সিদ্দিক কে বন্দি করে আগরতলা জয় বাংলা অফিসে নিয়ে যায়।আমরা বুঝে উঠার আগেই এই ঘটনা ঘটে যায়।পুনরায় বিকেলে আমরা মিছিল সহ মালা পরিয়ে ক্যাম্প প্রধান হিসেবে কাজী আকবর উদ্দীন সিদ্দিক কে ফিরিয়ে আনি।অপরাধীরা নি শর্তঃ ক্ষমা প্রার্থনা করে বিষয়টির এখানেই সমাপ্তি ঘটে।

একদিন কোনো এক অনুষ্ঠানে জ্বালাময়ী বক্তব্য দেন আ,স,ম আব্দুর ব।এসকল ক্যাম্প থেকেই বাছাই করে ট্রেনিং ক্যাম্পে নেয়া হত।একদিন রিক্রুট টিমের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার চেয়ারম্যান জনাব মাহবুবুল হুদা আসেন তিতাস ক্যাম্পে।আমার ছোট ভাই মজিবুর রহমান খাণ (ছালেক)রিক্রুট হয়ে ট্রেনিংয়ে চলে যায়।তখন সবাই ট্রেনিংয়ে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু প্রার্থীর প্রচন্ড চাপ। আমি নিজেও রিক্রুট হতে পারছিলাম না।হঠাৎ রাস্তায় আমার স্যার জনাব আবু আহম্মদ প্রধান শিক্ষক (শাহবাজপুর উচ্চ বিদ্যালয়,সরাইল,ব্রাহ্মণবাড়িয়া)সঙ্গে দেখা।আমি শাহবাজপুর স্কুলে নিয়মিত ছাত্র ছিলাম।স্যার গোকন নগর ট্রেনিং ক্যাম্পের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা।স্যারের সাথে যোগাযোগে চলে যায় গোকন নগর।শামসু ভাই,নোয়াব এরা আমার সাথে ছিল।

গোকন নগর ক্যাম্পে পদ্মা মেঘনা নামে দুইটি কোম্পানি ছিল।এখানে যুদ্ধের কলা-কৌশল গ্রেনেড রাইফেল ইত্যাদি ট্রেনিং চলত।৮/৯ দিন পর ভারতীয় আর্মির টিম আসে ট্রেনিংয়ে লোক নেয়ার জন্যে। এবং ইন্টারমিডিয়েট ছেলেদেরকে বাছাই করার জন্য আমাকে Beautiful বানানটা বলতে বলা হয়েছিল।আমরা ২০ জন রিক্রুট হয়ে আসাম প্রদেশের শিলচর জেলার লায়লাপুর সাব ডিভিশনের একটা গহীন জঙ্গের ভেতরে একটা ট্রেনিং সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়।ক্যাম্পের তিনটা উইং ছিল, মুজিব উইং-নজরুল উইং -তাজউদ্দিন উইং।

আমি নজরুল উইংয়ে ছিলাম।ট্রেনিং ক্যাম্প অত্যন্ত নিয়ম শৃঙ্খলার মধ্যে পরিচালিত হত।যে বেরাকে থাকতাম,দুই লাইনে শুইতাম।রাস্তা ছিল দুই লাইনের মাঝামাঝি। আড়াই তিন হাতের বেশি জায়গা দখল করতে পারতাম না।রাত ৯ টাই বাতি নিভিয়ে দিত। জংঙ্গলের ভিতর টাট্টি । বোতলে পানি নিতাম। দুপুরে খাবার ছিল-২ টা রুটি ১ প্লেট ভাত,সবজি ডাল রাতের খাবারও একই রকম।তবে খাবার মোটামুটি ট্রেনিং সেন্টারে ভালই ছিল।সন্ধ্যায় একটু আনন্দ ফুর্তিও চলত।শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারনে ভারতীয় সেনা সদস্যকেও কঠিন সাজা দিতে দেখেছি।ক্যাম্পে যাওয়ার সংঙ্গে সংঙ্গে আমাদেরকে বাসুন মগ শার্ট সাবান তৈল ইত্যাদি দেওয়া হয়।ভোর পাচঁটা সারে পাচঁটায় বাশি বাজার সাথে সাথে বিছানা গোটাইয়া,হাত মুখ ধুইয়া,১ মগ চা ১টা পুরি খাইয়া পিটি পেরেড শেষে এসেম্বলি হত।এসেম্বলিতে পাসওয়ার্ড ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কথা বলত।

এ কার্যক্রম চলত দুই আরাই ঘন্টা।এসেম্বলি শেষে এক ঘন্টার মধ্যে রুটি ভাজি চা খেয়ে তৈরি হয়ে থাকতাম।৯ টার দিকে উস্তাদের সংঙ্গে অস্রাগারে গিয়ে অস্র নিয়ে ট্রেনিং স্পটে যাইতাম।ট্রেনিং স্পট হল জঙ্গল পরিষ্কার করে বসার ব্যাবস্থা।উস্তাদ কোনোদিন রাইফেল কোনোদিন এস এল অার কোনোদিন এল এম জি,ষ্টেনগান, গ্রেনেড।প্রায় দেড় মাস অত্যন্ত অান্তরিকতার সহিত অস্র পরিচালনার কলা কৌশল শিখাইত।প্রতিটি অস্র ৮/১০ দিন শেখানোর পর ফায়ার স্পটে ফায়ার করে পরীক্ষা দিতে হত।এইভাবে উল্লেখিত প্রতিটা অস্র পরিচালনা শিখি।গ্রেনেড সরাসরি চার্জ করে পরীক্ষা দেই।

সাথে সাথে যুদ্ধের কলা-কৌশল, এম্বোস কিভাবে করে,রেড কি বা নাইট পেরেড ইত্যাদি।প্রতিবার ট্রেনিং শেষে প্রায় ছয়/সাতশো মুক্তিযুদ্ধা হেড কোয়াটার বা সেক্টর ভিত্তিক পাঠানো হত আবার নতুন নিয়ে আসত।ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু আমাদের বিশজনকে আরও ৮/১০ রেখে জুনিয়র লিডারশীপ ট্রেনিং দেয়া হয়।কিভাবে একটা টিম পরিচালনা করতে হয়,কিভাবে কমান্ড করা উচিত,কখন কোথায় যাওয়া উচিত ইত্যাদি।এ ক্লাস গুলি এখনো অামার জীবনের পাথেয়।ট্রেনিং শেষে আমাদের প্রত্যেকের বুকে নাম্বারযুক্ত প্লেট লাগিয়ে ছবি তুলে।লিখার শুরুতে যার কথা ভেবেছি যিনি ট্রেনিংয়ের পুরোটা সময় অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত আমাদেরকে অস্র চালনা শিখিয়েছেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথা

ওনাকে রিটায়ার আর্মি বলে মনে হত।প্রকৃতপক্ষে ওনি ছিলেন সন্যাস বা সাধু।আমি শ্রদ্ধা ভরে স্বরন করি সর্গই হওক ওনার ঠিকানা। ট্রেনিং শেষে দুইটি ট্রাক যোগে অামাদের বিশ জনকে হেডকোয়াটার আগরতলা পাঠিয়ে দেয়া হয়।আগরতলা থেকে লায়লাপুর দু্র্গম পাহাড়,ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তা দূরত্ব ২০০ কি মিঃ কম নয়।দুইটি ট্রাক একসঙ্গেই ছিলাম।চলতে চলতে হটাৎ খবর পেলাম আমাদের সঙ্গে থাকা ট্রাকটি এক্সিডেন্ট করেছে।আজও জানিনা ঐ দিন কি ঘটেছিল। তারপর হেডকোয়াটার হয়ে তিন নম্বর সেক্টরে গিয়ে দেখি ছালেক অস্র নিয়ে প্রস্তুত।৩/৪ ঘন্টার মধ্যে তার টিমের সংঙ্গে তেলিয়াপারার দিকে চলে যায়।ছালেকের সংঙ্গে অামার টর্চ লাইট, মুজিব কোর্ট ইত্যাদি বিনিময় হয়।

সেক্টরে প্রতিদিন সকালে হালকা ব্যায়াম বিকেলে এসেম্বলি হত।আমরা হাজির হতাম,পাসওয়ার্ড ইত্যাদি প্রয়োজনীয় কথা হয়ত।তখন সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কাজী নুরুজ্জামান এবং আঞ্চলিক কমান্ডার ছিলেন এজাজ অাহম্মেদ চৌধুরী। প্রায় রাতেই সেন্ট্রির ডিওটি করতাম।সপ্তাহখানেকের মধ্যে রসুল্লাবাদের আলি আযমকে কমান্ডার করে যৌথ বাহিনীর নেতৃত্বে একটা ট্রোপ তৈরি করে প্রয়োজনীয় অস্র গোলাবারুদসহ কসবা দিয়ে অামাদেরকে বাংলাদেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়।আমাদের ট্রোপস মোটামুটি অাধুনিক অস্রে সজ্জিত ছিল।আমাদের লক্ষ ছিল নবীনগর থানা হেডকোয়াটার।

আমর রসুল্লাবাদ এসে ছায়েদুর রহমান প্রিন্সিপাল(জগন্নাথ বিশ্ববাদ্যালয়) সাহেবের বাড়িতে উঠি।রাতে প্রিন্সিপাল সাহেবই তদারকি করে আমাদেরকে খাওয়ান।সকালে পাচঁ ঘন্টার ছুটি নিয়ে বাড়ি আসি।এসে দেখি আমাদের বাড়িতে আত্মীয় স্বজন অনেক।আব্বার ফুফাত ভাই আনু চাচা উনার ছেলে মেয়ে পরিবার নিয়ে আমাদের বাড়িতে অাছেন।যায় হউক আম্মার সাথে দেখা করে ঘন্টা খানেক বাড়িতে অবস্হান করে পূনরায় রসুল্লাবাদ টিমের সাথে চলে অাসি।নবীনগর থানা সদর প্রায় থম থমে অবস্থা।রাজাকার ও পাকিস্তান বাহিনীর নিয়ন্ত্রনে।

যদিও অাসেপাশের গ্রামগুলিতে ছিল মুক্তিযুদ্ধাদের বিচরন।ইতোমধ্যেই যৌথবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়ে গেছে।আমরা রসুল্লাবাদ থেকে রাতের অন্ধকারে আলমনগর বিলের ওপর দিয়ে নবীনগর সদরে এসে প্রবেশ করি।নবীনগর অাদালত ভবনের ছাদে একটা সদ্য ফাকা ব্যাংকার পাই।গুলি ছুরতে ছুরতে আমরা থানা ভবনের দিকে যায়।থানা চত্তরে গ্রেনেড চার্জ করি।থানা চত্তরে অনেক রাজাকার মারা পরে।ইতিমধ্যে জনতাও অামাদের সঙ্গে যোগ দেয়।থানার সমস্ত পরিত্যক্ত অস্র সরিয়ে অাদালতের কাছে একটা গোডাউনে নিয়ে যাওয়া হয়।

পাকিস্তানী বাহিনী তখন ঘোষনা করে অাত্বসমর্পন করে এবং নবীনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়।মুক্তিযুদ্ধাদের ঘেরাওয়ের মধ্যেই দুই তিন পর ভারতীয় বাহিনী এসে তাদেরকে নিয়ে যায়।অামরা থানা ভবনে অবস্থান করি।মাঝিকারা, আলমনগর বিভিন্ন এলাকা থেকে অামাদের জন্যে খাবার নিয়ে অাসা হত।বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত অামরা থানা ভবনেই অবস্হান করি। জাতীয় স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর কাছে অস্র সমর্পন অনুষ্ঠানে অস্র গোলাবারুদ সহ আগের দিন সকাল ৬ টায় নবীনগর থেকে লঞ্চযোগে সন্ধ্যায় সদরঘাট পৌছি।রাতে অামাদেরকে বিশ্ববাদ্যালয় নিয়ে যাওয়া হয়।একটি কম্বল ও ৫০টি টাকা দেওয়া হয়।পরদিন সকাল নয়টার দিকে অামাদেরকে জাতীয় স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধুর অনুষ্ঠানস্থলে নেওয়া হয়।অস্র জমা দিয়ে বাড়ি ফিরি এবং ব্রাক্ষণবাড়িয়া কলেজে আই.এস.সি ফাইনাল পরিক্ষায় অংশগ্রহন করি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আত্মকথা

আরও দেখুন


সামসুল আরেফিন খান