জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন

৬৮ হাজার অনলাইন গ্রাম: বাংলাদেশের গ্রাম

আবদুল কুদ্দুস মাখন: স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম সদস্য, জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন। তিনি হচ্ছেন তিতাস পাড়ের গর্বিত সন্তানদের মধ্যে একজন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার অবদান অনস্বীকার্য। বাঙালি জাতির এই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশের মানুষের কাছে তিনি চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৪৭ সালের ১লা জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অদুরে পুনিয়ট গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তার বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। এমন সন্তান জন্ম দিয়ে যারা তার গর্বিত হলেন সেই জনক ও জন্মদাত্রী হলেন জনাব মোহাম্মদ আবদুল আলী এবং মোসাঃ আমেনা খাতুন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরেই কাটে মাখনের শৈশবকাল,বেড়ে উঠেন সংস্কৃতির রাজধানীর পরিবেশে।

ছোটবেলা থেকেই মাখন অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার জন্য তাকে ভর্তি করানো হয় শহরের অন্যতম বিদ্যাপীঠ নিয়াজ মুহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয়ে
। সেখান থেকে ১৯৬২ সালে মানবিক শাখায় প্রথম বিভাগ পেয়ে এই মেধাবী ছাত্র মাধ্যমিক পরিক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর ১৯৬৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তারপর জন্য উচ্চ শিক্ষার জন্য ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে সমাজবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। পরে ১৯৬৯ সালে মাস্টার্স শেষে তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।

আবদুল কুদ্দুস মাখন’র রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় সেই হাই স্কুলে পড়াকালীন সময়েই। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়াকালীন সময়ে তিনি ছাত্রলীগের অন্যতম নেতা হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯৬৬-৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ-সাধারন সম্পাদক, অতঃপর ১৯৬৮-৬৯ সালে সাধারন সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের অবদান অনস্বীকার্য। বলাই বাহুল্য তাদের নেতৃত্বেই সকল আন্দোলনগুলো এগিয়ে যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যূত্থানেও তারা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৭০ সালের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
তারপর তিনি ছাত্রলীগের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য সকল ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তৎপর হন। তারই নির্দেশনায় গোটা ছাত্রসমাজ ছাত্রলীগের সাথে হাত মেলায়। যা পরবর্তী প্রত্যেকটি আন্দোলনকে বেগবান করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে দিলে এদেশের মানুষের পাকিস্তানি নেতাদের ষড়যন্ত্র বুঝতে আর বাকি থাকে না। ছাত্রনেতাদের সমন্বয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। যার চার সদস্যের অন্যতম হলেন আবদুল কুদ্দুস মাখন। বাকি
তিন সদস্য হলেন জনাব আ. স. ম.আবদুর রব,জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, জনাব শাহজাহান সিরাজ। তাঁরা চার খলিফা বলে খ্যাত ছিলেন।

১৯৭১ সালের ২রা মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে সারা বাংলার ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসে। অসহযোগ আন্দোলনে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ খুবই সক্রিয় ভুমিকা পালন করে। তাঁরা ২রা মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরের দিন ৩রা মার্চ রাজধানীর পল্টন ময়দানে এক বিশাল ছাত্র সমাবেশে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেন। তাঁরাই প্রথম বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে স্বাধীন বাংলার ইশতেহার পাঠ করেন। এই ঐতিহাসিক সম্মেলনেই স্বাধীন বাংলার পতাকা ও জাতীয় সংগীত নির্ধারণ করা হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির জনক’ ঘোষণা করা হয়।

পরবর্তী ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণে যেসব দিক নির্দেশনা দেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তা পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ২৩ শে মার্চ পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন। পরে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে তাঁর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেন। একই দিনে সমগ্র বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এদেশের মানুষদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য নানা প্রদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

আবদুল কুদ্দুস মাখন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যের অন্যতম সদস্য। সুতরাং স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সংগঠিত আন্দোলন ও সংগ্রামে তাঁর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে মাখন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করার মহা দায়িত্ব পালন করেন।জনাব মাখন বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে গঠিত) সকল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দান ও অস্ত্র সরবরাহের গুরু দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন । মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবেও জনাব মাখন বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন মহান সংগঠক হিসাবে জনাব মাখনের ঐতিহাসিক অবদান দেশ ও জাতির নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠন করার জন্য তিনি দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। ১৯৭২ সালে ডাকসু’র সহ-সভাপতি জনাব আ. স. ম. আবদুর রব ও ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন এর নেতৃত্বে ডাকসুর পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্মাননা স্বরুপ ডাকসু’র আজীবন সদস্যপদ প্রদান করা হয়। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। ১৯৭২ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী মেলায় তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭৪ সালে তিনি জার্মানির বার্লিনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিশ্ব যুব উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে অংশ গ্রহণ করেন।

মাটি ও মানুষের নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডিয়াম সদস্য মনোনিত হন। একই বছর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ২৩শে আগষ্ট রাতে জনাব মাখনসহ অনেক নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘ তিন বছর পর ১৯৭৮ সালের ১২ নভেম্বর জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। অতঃপর আবার আওয়ামী লীগের হয়ে জনসেবায় মনোনিবেশ করেন।

বাংলার মাটি ও মানুষের নেতা আবদুল কুদ্দুস মাখন জীবনকালের শেষ দিকে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসে সংক্রমণে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হন। ১৯৯৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৪৭ বছর বয়সে আমেরিকার ফ্লোরিডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইহলোক ত্যাগ করেন। বাংলার মানুষ হারায় তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে।