আকদিয়া গ্রাম গুনবতী ইউনিয়ন

আকদিয়া গ্রাম গুনবতী ইউনিয়ন

আকদিয়া,সুজলা-সুফলা শষ্য-শ্যামলা অপরূপ বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার গুণবতী ইউনিয়নের ডাকাতিয়া নদীর কোলঘেষে গড়ে উঠা একটি গ্রাম। ১.৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই গ্রামটিতে দুই সহস্রাধিক মানুষের বাস। তিনদিকে নদীবেষ্টিত গ্রামটিতে রয়েছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য।

এই গ্রামের ইতিহাস প্রায় ৪০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী। আকদিয়া পুর্বপাড়ায় অবস্থিত শতাব্দীপ্রাচীন বৃক্ষরাজি তারই ঐতিহ্য বহন করে। আকদিয়ার জন্ম-ইতিহাসের সাথে সর্বাঙ্গীণভাবে জড়িয়ে আছে হযরত অলিমান দেওয়ান শাহ (রহঃ) এর ইতিহাস। কারন তিনিই আকদিয়ায় প্রথম বসতিস্থাপণকারী।

ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে বাংলায় বহু আউলিয়া কেরামের আগমণ ঘটে। তাঁদের অন্যতম হযরত শাহ জালাল (রহঃ)। তিনি ও তাঁর সফরসঙ্গীগণ আরব হতে বাংলায় আগমণ করে সিলেটে বসতিস্থাপন এবং ইসলাম প্রচার করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ষোড়শ শতাব্দীতে তাঁদের উত্তরসূরীগণের মধ্য হতে কিছু আউলিয়া কেরাম ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সিলেট হতে ত্রিপুরায় লালমাই নামক স্থানে আসেন।

তাঁদের অন্যতম হযরত অলিমান দেওয়ান শাহ (রহঃ)। তিনি লালমাই হতে আরো কিছুপথ অতিক্রম করে ডিঙ্গি নৌকায় করে ডাকাতিয়া নদীতে পাড়ি দিতে থাকেন। পথিমধ্যে সালাতের সময় হওয়ায় বর্তমান আকদিয়া ভূখন্ডে সালাত আদায় করেন। সালাত আদায় শেষে তিনি যখন আবার নৌকায় উঠেন তাঁর পোষ্য বিড়ালটি ডিঙা থেকে লাফ দিয়ে নেমে যায়। এভাবে বারংবার উঠানোর পরেও বিড়ালটি লাফ দিয়ে নেমে যায়।

এরপর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে এখানেই তার ইসলাম প্রচার ও স্থায়ী বসতিস্থাপনের উপযুক্ত স্থান। তিনি এখানে বসতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে যাবতীয় কার্যাবলী সম্পাদন করেন। তিনি আকদিয়ার প্রধান খালের পূর্বপাড়ে বর্তমান আকদিয়া মজুুমদার বাড়ীতে (বর্তমান জাহাঙ্গীর কোম্পানীর বাড়ী) বসতিস্থাপন করেন। বংশ পরম্পরায় তাঁর বংশধরগণ ঐ বাড়ীতে বসবাস করছেন। তিনি এই বাড়ীর পূর্বপাশে দ্বীনপ্রচারের দরবার তথা তাকিয়া স্থাপন করেন। তার ইন্তেকালের পর এটি পরিত্যাক্ত হয়ে যায়।

আকদিয়ার পূর্বনাম ছিল আগদিয়া। পরবর্তীতে জনমুখে উচ্চারণ বিবর্তিত হয়ে আগদিয়া থেকে আকদিয়া হয়ে যায়। আগদিয়া নামকরণ নিয়ে বহুমত প্রচলিত আছে। আগ শব্দের অর্থ অগ্রগামী, প্রাচীন, পূর্ব, পূর্বদিক, সম্মুখভাগ ইত্যাদি। দিয়া শব্দের অর্থ দ্বীপ। আগদিয়া শব্দের অর্থ পূর্বের দ্বীপ বা প্রাচীন দ্বীপ। চারদিকেই নদী ও খাল তথা পানিবেষ্টিত হওয়ায় একে দিয়া বলা হয়। ঐতিহাসিক তথ্য মতে হোমনাবাদ পরগনার পূর্বদিকস্থ প্রাচীন একটি দ্বীপ হওয়ায় একে আগদিয়া নামে ডাকা হতো। অপর একটি মতে হোমনাবাদ অঞ্চলের ( ডাকাতিয়া নদী পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত পরগনা) সম্মুখভাগের হওয়ায় একে আগদিয়া বলা হয়।

আকদিয়ায় প্রথম বসতিস্থাপনকারী ছিলেন হযরত অলিমান দেওয়ান শাহ (রহঃ) এর ছিল তিনপুত্র। জিয়স মজুুমদার, খওয়াজ মজুমদার, তিতাজী মজুুমদার। পিতার ধারাবিকতায় জ্যেষ্ঠপুত্র জিয়স মজুমদার আকদিয়া মজুুমদার বাড়ীতেই (বর্তমান জাহাঙ্গীর কোম্পানীর বাড়ী) জীবন অতিবাহিত করেন। তাঁর বংশধরগন আজও মজুুমদার বাড়ীতেই বসবাস করছে। অপরপুত্র খওয়াজ মজুমদার ছিলেন নিঃসন্তান। তিনিও আজন্ম একই বাড়ীতেই জীবনযাপন করেন। নিঃসন্তান হওয়ায় তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে “খওয়াজ মজুমদার পুকুর” নামে রায়ত তথা প্রজাদের পানি চাহিদা মিটাতে গ্রামে একটি পুকুর খনন করা হয় (যা দক্ষিণ পাড়ায় অবস্থিত মজুমদার পুকুর)।

দেওয়ান শাহ (রহঃ) কনিষ্ঠপুত্র তিতাজী মজুুমদার তাঁর পৈত্রিকবাড়ীর (মজুুমদার বাড়ী) উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে খালের পশ্চিম পাশে বসতি স্থাপন করেন। বর্তমান স্কুল সংলগ্ন তিতাজী মজুুমদার বাড়ীতে তাঁর বংশধরগণ বসবাস করছে। দেওয়ান শাহের প্রতিষ্ঠিত মসজিদের মুয়াজ্জিন ছিলেন আনছর আলী মিয়াজী নামে অতন্ত্য ধর্মভীরু এক আলেম । তিনি আকদিয়া মজুুমদার বাড়ীর পাশে বর্তমান মিয়াজী বাড়ীতে বসতি স্থাপন করেন। উনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে তিতাজী মজুুমদারের তালুক নিলাম হলে আটিয়াবাড়ীর ক্রোস মজুুমদার উক্ত নিলাম খরিদ করে এবং তাঁর ভাগ্নে আছাদ মজুুমদারকে দ্বায়িত্ব অর্পন করে।

আছাদ মজুমদার বর্তমান বড় মসজিদের পশ্চিমপাশে বসতি স্থাপন করেন। এরই ধারাবিকতায় মোল্লা বাড়ী, ভূঞা বাড়ী, আলী বেপারী বাড়ী, আমির উদ্দিন হাজী বাড়ী, বন্দে আলী বেপারী বাড়ী, ফরায়েজী বাড়ী, আবদুল হাজী বাড়ীতে বসতি গড়ে উঠে। হযরত অলিমান দেওয়ান শাহ (রহঃ) ইন্তেকালের প্রায় দুই শতাব্দী পরে বাসুদাই নিবাসী মিঞাজান বেপারী দেওয়ান শাহের ব্যবহৃত পরবর্তীতে পরিত্যাক্ত তাকিয়াতে বসতি স্থাপন করেন। এভাবে সমগ্র গ্রামে বিভিন্ন অঞ্চল হতে মানুষ বসতি স্থাপন অব্যাহত রাখেন। ফলে জনশুন্য আকদিয়া হয়ে উঠে জনাকীর্ণ।

প্রাথমিক যুগে আকদিয়া ছিল তৎকালীন ত্রিপুরা জেলার হোমনাবাদ পরগণার অন্তর্গত। হযরত অলিমান দেওয়ান শাহ (রহঃ) এ অঞ্চলের দেওয়ানী (প্রশাসক) পরিচালনা করেন। তিনি আকদিয়ায় ইসলামী সমাজব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র জিয়স শাহ মজুমদার ও তাঁর বংশধরগণ বংশপরম্পরায় এই অঞ্চলের প্রশাসক হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তীতে ১৭৯৩ চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন হলে মৌজার ভূম্যাধিকারী হিসেবে তাঁরা মজুুমদার পদবী লাভ করেন। আধুনিক যুগে ১৯০৫ সালে চৌদ্দগ্রাম থানা প্রতিষ্ঠিত হলে আকদিয়া চৌদ্দগ্রাম থানা অন্তর্গত বক্সগঞ্জ ইউনিয়নের অন্তভূক্ত হয়।

তৎপরবর্তীতে সাতবাড়ীয়া ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা হলে আকদিয়া সাতবাড়ীয়ার অন্তভূক্ত হয়। কিন্তু প্রশাসনিক সুবিদার জন্য ১৯৮১ সালে আকদিয়াকে গুনবতী ইউনিয়নে সংযুক্ত করা হয়। এভাবেই এই গ্রামে অতিবাহিত হয়েছে প্রায় দশটি প্রজন্ম। রেখে গিয়েছে তাঁদের সহস্র স্মৃতিকথা। স্বশ্রদ্ধচিত্তে স্মরণ করছি শত শত বছরের ইতিহাসের সে সকল গুনীজনদের, যাদের বদৌলতে আমরা পেয়েছি সুখী-সমৃদ্ধ সুন্দর একটি গ্রাম। আমরা সবাই মিলে আকদিয়াকে ভালো রাখি, সুন্দর রাখি, শান্তিতে রাখি। ভালো থাকুক আকদিয়া, ভালো থাকুক আকদিয়ার প্রতিটি মানুষ, মহান আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।

তথ্যসুত্র
* ঐতিহাসিক তথ্যাবলী
* ভূমি সংক্রান্ত কাগজপত্রাদি
* ভোটার তালিকার তথ্য
* আদমশুমারী ও গৃহগণনা প্রতিবেদন
* ইতিহাস বিষয়ক গ্রন্থাবলী