তিতাস পাড়ের সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মন

অদ্বৈত মল্লবর্মন বাংলা সাহিত্যের একজন কালজয়ী ঔপন্যাসিকের নাম। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি লাভ করেন। যেসব লেখক বাংলার মানুষের জীবনযাত্রা ও দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে কলম ধরেছেন অদ্বৈত মল্লবর্মন তাদেরই একজন। লৌকিক সাহিত্যে অবদানের জন্য তিনি আজও মানুষের হৃদয়-কোটরে বেঁচে আছেন।

তিতাস পাড়ের সন্তান অদ্বৈত মল্লবর্মন ১৯১৪ সালের ১লা জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের অদুরে গোকর্ণঘাট নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অধরচন্দ্র মল্লবর্মণ এবং মাতার নাম সারদা দেবী। তার পিতা ছিলেন একজন দরিদ্র জেলে। অদ্বৈতের ছেলেবেলায় তার বাবা-মা উভয়েই মারা যান। তার ছোট দুই ভাইও অল্প বয়সে মারা যান। সর্বহারা অদ্বৈতের বিধবা বড় বোন শুধু বেঁচে ছিলেন।

অদ্বৈত লেখাপড়ার প্রতি খুবই অনুরাগী ছিলেন। কিন্তু আর্থিক সংকটের জন্য যেন গরীবের ঘোড়া হয়ে দাড়িয়েছিল। অবশেষে গ্রামের মালো সম্প্রদায়ের অনুদানে চলতে থাকে এই পিতৃ-মাতৃহীন প্রতিভাবানের পড়াশুনা। ভর্তি হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া এডওয়ার্ড হাই স্কুলে। সেখান থেকে ১৯৩৩ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন। অতঃপর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। বছরখানিক পড়াশোনা করার পর আবারো বিপদ নেমে আসে অদ্বৈতের ভাগ্যাকাশে। তার আশ্রয়দাত্রী কল্পনা দেবী গ্রেফতার হন। ফলে তিনি নিরাশ্রয় হয়ে পড়েন। এভাবেই তাঁর শিক্ষাজীবনের ইতি ঘটে।

অতঃপর জীবিকার তাগিদে পাড়ি জমান কলকাতায়। সেখানে ১৯৩৪ সালে মাসিক ‘ত্রিপুরা’ পত্রিকায় সাংবাদিকতার মাধ্যমে তার কর্মজীবনের সূচনা ঘটে। তারপর ১৯৩৬ সালে ‘নবশক্তি’ প্রত্রিকায় সহ-সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪২ সালে ‘নবশক্তি’ বন্ধ হয়ে গেলে মওলানা আকরাম খাঁ’র ‘মাসিক মোহাম্মদী‘ পত্রিকায় যোগদান করেন। একই সাথে তিনি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকাতেও সাংবাদিকতা করেন। এরপর ‘নবযুগ’, ‘কৃষক’ এবং ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় খন্ডকালীন সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪৫ সালে সাগরময় ঘোষের সাথে পরিচয় ঘটে। তাঁরই একান্তে আগ্রহে যোগ দেন ‘দেশ’ পত্রিকায়। রোগাক্রান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ‘দেশ’ পত্রিকাতেই কাজ করেন।

মাসিক মোহাম্মাদী পত্রিকায় ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৫ ধারাবাহিকভাবে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটি মুদ্রিত হতে থাকে। অতঃপর মতবিরোধের কারনে সেখানকার চাকরি ছেড়ে দেন। এরই মধ্যে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির পান্ডুলিপিও হারিয়ে ফেলেন। পরে বন্ধুদের অনুরোধে তিনি পুনরায় উপন্যাসটি লেখার মনস্থির করেন। মৃত্যুর পূর্বে তিনি নতুন করে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসটির পান্ডুলিপি প্রস্তুত করতে সক্ষম হন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৫৬ সালে পুঁথিঘর থেকে প্রকাশিত হয়।

মানিক বন্দোপাধ্যের কৈবর্ত সম্প্রদায়কে নিয়ে ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ রচনা করেন। তারপর একই ধারার পর লেখেন অদ্বৈত। এ বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলেন, “মানিক বন্দোপাধ্যায় বড় আর্টিস্ট , মাস্টার আর্টিস্ট, কিন্তু বাওনের (ব্রাহ্ম‌ণের) পোলা – রোমান্টিক। আর আমি তো জাউলার (জে‌লের) পোলা।”
অদ্বৈত মল্লবর্মন নিজেই ছিলেন একজন মালো সম্প্রদায়ের লোক। জেলে পরিবারের সুখ-দুঃখ তার বাস্তব জীবনের উপলব্ধি। এই উপন্যাসের মাধ্যমে তিনি যেন বাস্তবতাকে শব্দমালার গাঁথুনি দিয়ে তুলে ধরেছেন। তার এই উপন্যাসটির প্রতি মুগ্ধ হয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটক ১৯৭৩ সালে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ শিরোনামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। 

তিনি ‘জীবনতৃষ্ণা’,‘রাঙামাটি’ এবং ‘শাদা হাওয়া’  নামের তিনটি উপন্যাস; ‘স্পর্শদোষ’,‘তমোনাশের মন’ , ‘বন্দীবিহঙ্গ’ , ‘সায়ন্তিকা’ , ‘বিস্ময়’ ও ‘কান্না’ শিরোনামের ছয়টি ছোটগল্প রচনা করেন। এছাড়াও তিনি কিছু কবিতা ও প্রবন্ধও রচনা করেছিলেন। উপন্যাসের মধ্যে ‘জীবনতৃষ্ণা’ তার মৌলিক রচনা ছিল না। এটি ছিল আরভিং স্টোনের উপন্যাস ‘লাস্ট ফর লাইফ’ এর বঙ্গানুবাদ। এটি কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় ১৯৫০ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হয়। অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে ‘রাঙামাটি’ উপন্যাসটি ১৩৭১ বঙ্গাব্দে ‘চতুষ্কোণ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়।আর ১৩৫৫ বঙ্গাব্দের শারদ সংখ্যায় ‘শাদা হাওয়া’ উপন্যাসটি ‘সোনারতরী’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়।

অদ্বৈত মল্লবর্মন একজন উদার হৃদয়ের মানুষ। হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে তিনি যা রোজগার করতেন তার সিংহভাগই দুস্থ পরিজনদের মাঝে ব্যয় করতেন। যেজন্য বন্ধুরা তার সম্পর্কে বলেন, ‘আমরা চিরকাল অদ্বৈতকে তাহার মুষ্টি অন্য বহুজনের সঙ্গে ভাগ করিয়া খাইতে দেখিয়াছি।’ তাছাড়া তিনি তার উপার্জনের একটি অংশ কলকাতার মালোপাড়ার শিশি-কিশোরদের পড়াশুনার উপেন্দ্রবাবুর স্বল্পশিক্ষিত বিধবা প্রফুল্লকে নিয়মিতভাবে প্রদান করতেন।

অদ্বৈত খুবই বই প্রেমিক মানুষ ছিলেন। আর্থিক অভাব-অনটন থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রচুর পরিমানে বই কিনতেন। তার মৃত্যুর পর তার সমস্ত বই ‘রামমোহন লাইব্রেরি’ প্রেরণ করা হয়। লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ তার সহস্রাধিক বইয়ের সংগ্রহকে আলাদা একটি বিভাগ তৈরি করে যত্নসহকারে সংরক্ষণ করেন।

দরিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে এই সাহিত্যিক অল্প বয়সেই যক্ষা রোগে আক্রান্ত হন। যা তাঁকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দেয়। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে ১৯৫১ সালের ১৬ এপ্রিল অমর কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মন কলকাতার নারকেলডাঙ্গার ষষ্ঠীতলার বাড়িতে পরলোক গমন করেন। আমরা হারায় বাংলা সাহিত্যের এক প্রতিভাবান শিল্পীকে।