মুক্তিযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত দুই আবু সালেহ।
মুক্তিযুদ্ধে খেতাব প্রাপ্ত দুই আবু সালেহ এর গল্প। দুজনেই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সন্তান। যুদ্ধ করেছেন দেশের জন্য। যুদ্ধের পিছনে তাদের উদ্দেশ্যে যেমন ছিল মিল তেমনি তাদের নামেও অনেক টা মিল খোঁজে পাওয়া যায়।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম
(জন্ম ৪ জানুয়ারি ১৯৮৪ খ্রি)
আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের পৈতৃক বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মাছিহাতা ইউনিয়নের চাপুইর গ্রামে। তার পিতার নাম মোহাম্মদ ইদ্রিস এবং মাতার নাম চেমন আরা বেগম। তার স্ত্রীর নাম সৈয়দা ইসমাত নাসিম। তাদের দুই মেয়ে, এক ছেলে।
আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম ১৯৭১ সালে কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ২৫ মার্চের পর কে এম সফিউল্লাহর (বীর উত্তম) নেতৃত্বে ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিরোধযুদ্ধে নাসিমের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তখন তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষ এবং ভারতে পুনঃসংগঠিত হওয়ার পর নাসিম প্রথমে ৩ নম্বর সেক্টরের পঞ্চবটি সাব-সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত হন।
পরে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ‘এস’ ফোর্সের অধীন ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আশুগঞ্জ, মনতলা, মাধবপুর , শাহবাজপুর এবং চান্দুরার যুদ্ধ তার জীবনের উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ ছিল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত হন। ১৯৯৬ সালে সেনাপ্রধান হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কথিত অভ্যুত্থানের অভিযোগে তিনি অভিযুক্ত হন ফলে চাকরি হারায়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে ১৩-১৪ এপ্রিল আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম সহযোদ্ধাদের নিয়ে আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আশুগঞ্জ দখলের জন্য ১৩ এপ্রিল সড়কপথে পার্শ্ববর্তী ভৈরবে উপস্থিত হয়। পরদিন আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের পেছনে হেলিকপ্টারে কমান্ডো ব্যাটালিয়নের প্রায় এক কোম্পানি সেনা নামে। গানবোট ও অ্যাসল্ট ক্রাফটের সাহায্যে নদীপথেও সেনা আসে।
১৪ এপ্রিল সকাল থেকে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর কয়েকটি জঙ্গি বিমান আশুগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আকাশ থেকে ব্যাপক গোলাগুলি করে। এর ছত্রচ্ছায়ায় দুপুর ১২টার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি দল হেলিকপ্টারে করে নাসিমের প্রতিরক্ষা অবস্থানের পেছনে অবতরণ করে। আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম এতে দমে না গিয়ে অব্যাহত বিমান হামলার মধ্যেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও দ্রুততার সঙ্গে নিজেদের প্রতিরক্ষা অবস্থান পুনর্বিন্যাস করেন। এর পর দ্রুত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের আক্রমণের ধারা ও অবস্থান চিহ্নিত করে সহযোদ্ধাদের নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলের মুখোমুখি হন।
প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। নাসিম সহযোদ্ধাদের নিয়ে বিক্রমের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো দলকে মোকাবিলা করেন। তার সহযোদ্ধাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতায় কমান্ডোরা কিছুটা পিছু হটে। তবে পাকিস্তানিরা ছিল যথেষ্ট বেপরোয়া। জীবনের মায়া ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা আবার সংগঠিত হয়ে নাসিমের দলকে পাল্টা আক্রমণ করে। চার ঘণ্টা ধরে যুদ্ধ চলে। কোনো স্থানে প্রায় হাতাহাতি যুদ্ধও হয়। একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনারা আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিমের দলকে প্রায় ঘেরাও করে ফেলে। তারা প্রায় জীবনসন্ধিক্ষণে পড়েন। তখন তার সহযোদ্ধাদের বেশির ভাগ আহত এবং কয়েকজন শহীদ। তিনি নিজেও আহত হন।
এই অবস্থায় নাসিমের সামনে পশ্চাদপসরণ করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না। শহীদদের মরদেহ সমাহিত করার ব্যবস্থা করে রাতের অন্ধকারে তিনি আগত সহযোদ্ধাদের নিয়ে সরাইলের দিকে পশ্চাদপসরণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতা যুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীর বিক্রম খেতাব প্রদান করে।
বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত কিশোর মুক্তিযোদ্ধা নায়েক আবু সালেহ
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়া উপজেলার হাসিমপুর (ভাটামাথা) গ্রামের ছেলে নায়েক আবু সালেহ। পিতার নাম আব্দুল হাশিম। ১৯৭১ সালে আবু সালেহ কেবল কসবা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে’র ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র । যুদ্ধ শুরু হলে অন্য অনেকের সাথে সেও উপস্থিত হলেন আগরতলায়।
তার উদ্দেশ্য যুদ্ধ করা ও দেশকে স্বাধীন করা। কিন্তু বয়স কম বিবেচনায় বাদ পড়তেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন ছোট্ট ছেলে আবু সালেহ। নজর এড়ালো না রিক্রুট অফিসারে’র । তার দৃঢ় একাগ্রতায় মুগ্ধ হয়ে দলভুক্ত করে পাঠিয়ে দিলেন মেঘালয়ে ট্রেনিং নিতে । নিলেন ট্রেনিং । এবার রণাঙ্গনের যুদ্ধে যাবার অপেক্ষা ।
এলো ডাক!
এতটুকু ভয় নেই চোখেমুখে , উল্টো যুদ্ধ জয়ের দৃঢ়তা । সম্মুখ সমরে সামিল হলেন চন্দ্রপুর নামক গ্রামে । এক সময় দলনেতা বুঝতে পারলেন পাকিস্তানীদের ভারী ও ব্যাপক অস্ত্রের সাথে পেরে উঠবেন না । সেক্ষেত্রে কৌশল হলো পিছনে হঠা।
কিন্তু অন্যদের পিছনে হঠার সুযোগ পেতে হলে কাউকে অবশ্যই কভার করতে হয় । ঐ টুকু বয়সের অকুতোভয় সালেহ নাছোড়বান্দা! সেই করবে কভার । হলোও তাই ।
বয়সের তুলনায় ভারী অস্ত্র হাতে গলা অব্দি বাংকারে ডুবিয়ে নাগাড়ে করে গেলেন ফায়ার । সহযোদ্ধারা সকলেই সরে গেলেন নিরাপদে । তবু থামলেন না সালেহ । চারদিকে অন্ধকার । মুহূর্মুহু কেবল গুলির শব্দ ।ওদিকে পাকিস্তানীদের ধারণা জন্মালো ,মুক্তিবাহিনী বুঝি সংখ্যায় এবং অস্ত্রে যথেষ্ট । ফলে সেইরাতে তাৎক্ষনিক ক্ষয়ক্ষতি মেনে নিয়ে পাকিস্তানীরাও হঠে গেল পিছনে ।
গোলাগুলির অবসান হলে দলপতি খুঁজতে এলেন তার ক্ষুদে যোদ্ধাকে । ভাবছিলেন শহীদের নিথর দেহটা না জানি তপ্ত সীসার আঘাতে কতটা ক্ষতবিক্ষত হয়েছে !
কিন্তু না ,বীর সালেহ চুপচাপ বসে ছিলেন বাংকারের অন্ধকারে
এইসব অগনিত বীর সালেহ’দের অকুতোভয় বীরত্বের বিনিময়ে এসেছে স্বাধীনতা । দেশের প্রতি ভালবাসা দেখিয়েছেন কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কখনোই পালিয়ে যাননি । বরং ঢাল হয়ে থেকেছেন সহযোদ্ধার সাথে বীরভূমি’র বীর সন্তান সালেহ।
স্যালুট কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আবু সালেহ। আপনার বীরত্ব আমাদের মুগ্ধ করেছে।
তথ্যসূত্র দৈনিক পত্রিকা প্রথম আলো, উইকিপিডিয়া এবং ফেসবুক গ্রুপ বাউনবাইরার কথা