নবীনগর উপজেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সবচেয়ে বড় উপজেলা। এই উপজেলার আয়তন প্রায় ৩৫০.৩৩ বর্গ কিলোমিটার । নবীনগর উপজেলায় বর্তমানে ১টি পৌরসভা ও ২১টি ইউনিয়ন রয়েছে। সম্পূর্ণ উপজেলার প্রশাসনিক কার্যক্রম নবীনগর থানার অন্তর্ভুক্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার দক্ষিণ পশ্চিম দিকে নবীনগর উপজেলা টি অবস্থিত। এই উপজেলার উত্তর দিকে রয়েছে আশুগঞ্জ উপজেলা ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা পূর্ব দিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা, দক্ষিণ-পূর্ব দিয়ে দিকে কসবা উপজেলা, দক্ষিণ দিকে কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলা পশ্চিম দিকে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে রয়েছে মেঘনা নদী, নরসিংদী জেলার নরসিংদী সদর উপজেলা ও রায়পুরা উপজেলা।
নবীনগর পৌরসভা
১৯৯৯ সালের ১২ সেপ্টেম্বর নবীনগর উপজেলার নবীনগর পূর্ব, শ্রীরামপুর ও ইব্রাহিমপুর তিন ইউনিয়ন অংশ নিয়ে নবীনগর পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়
নবীনগর পৌরসভার আয়তন প্রায় ১৫.৮১ বর্গ কিলোমিটার
এই পৌরসভার মোট জনসংখ্যা ৫৩,১৫৭ জন। মোট পরিবার ১০,৫৩৯ টি। প্রতি বর্গ কিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রায় ৩৩৬২ জন।
নবীনগর উপজেলার মধ্যবিন্দুতে নবীনগর পৌরসভা টি অবস্থিত। এই পৌরসভার পশ্চিম দিকে রয়েছে নবীনগর পশ্চিম ইউনিয়ন, দক্ষিণ দিকে শ্রীরামপুর ইউনিয়ন ও ইব্রাহিমপুর ইউনিয়ন, পূর্ব দিকে নবীনগর পূর্ব ইউনিয়ন এবং উত্তর দিকে রয়েছে তিতাস নদী ও কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন।
নবীনগর পৌরসভা একটি ‘ক’ শ্রেণীর পৌরসভা। এই পৌরসভার প্রশাসনিক সকল কার্যক্রম নবীনগর থানার অন্তর্ভুক্ত । এটি জাতীয় সংসদ এর ২৪৭ নং নির্বাচনী এলাকা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৫ আসনের অংশ বিশেষ। এটি ৯টি ওয়ার্ডে বিভক্ত।
ওয়ার্ড নং | ওয়ার্ড নাম |
১নং ওয়ার্ড | আলমনগর |
২নং ওয়ার্ড | পশ্চিম নবীনগর |
৩নং ওয়ার্ড | খাজানগর, গোপীনাথপুর, উত্তর নবীনগর |
৪নং ওয়ার্ড | নবীনগর মধ্য |
৫নং ওয়ার্ড | আলিয়াবাদ, মাঝিকাড়া |
৬নং ওয়ার্ড | জল্লা, উত্তর নারায়ণপুর |
৭নং ওয়ার্ড | দক্ষিণ নারায়ণপুর |
৮নং ওয়ার্ড | পূর্ব দোলাবাড়ী, নবীপুর, পূর্ব ভোলাচং |
৯নং ওয়ার্ড | ভেলানগর, পশ্চিম দোলাবাড়ী, পশ্চিম ভোলাচং, সোহাতা |
ইউনিয়ন নং | ইউনিয়ন নাম | আয়তন (একর) |
১ নং | বড়াইল | ৩৪২০ |
২নং | বীরগাঁও | ২৮২৭ |
৩ নং | কৃষ্ণনগর | ৫০৬৪ |
৪ নং | নাটঘর | ৬৪২৭ |
৫ নং | বিদ্যাকুট | ৬০০৩ |
৬ নং | নবীনগর পূর্ব | ৪২১৭ |
৭ নং | নবীনগর পশ্চিম | ২৫৪৮ |
৮ নং | কাইতলা উত্তর | ৫২২৫ |
৯ নং | বিটঘর | ৩৬৫৩ |
১০ নং | শিবপুর | ৫৯১৪ |
১১ নং | ইব্রাহিমপুর | ৩৪২১ |
১২ নং | শ্রীরামপুর | ৫৭৩৮ |
১৩ নং | লাউর ফতেপুর | ৪০৩৮ |
১৪ নং | জিনোদপুর | ৩৩৬৬ |
১৫ নং | রসুল্লাবাদ | ৩৮৯২ |
১৬ নং | সাতমোড়া | ৩৮৫৮ |
১৭ নং | শ্যামগ্রাম | ৫৬৬৯ |
১৮ নং | ছলিমগঞ্জ | ২২৯৮ |
১৯ নং | বড়িকান্দি | ৩২৬৩ |
২০ নং | কাইতলা দক্ষিণ | ৫২২৫ |
২১ নং | রতনপুর | ৬২৯৫ |
বিশেষ ব্যাক্তিবর্গ
অতীন্দ্রমোহন রায় >>> ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী।
আফতাবউদ্দিন খাঁ >>> লোকসঙ্গীত এবং যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী।
আবদুস সাত্তার খান >>> মহাকাশ গবেষক।
আবেদ হোসেন খান >>> একুশে পদক প্রাপ্ত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সেতার বাদক এবং সুরকার।
আলাউদ্দিন খাঁ >>> সেতার ও সানাই এবং রাগ সঙ্গীতে বিখ্যাত ঘরানার গুরু।
আলী আকবর খান >>> ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতের একজন সঙ্গীতজ্ঞ।
আহমেদ আলী >>> রাজনীতিবিদ, ভাষা সৈনিক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা।
আয়েত আলী খাঁ >>> মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সেতার এবং সুরবাহার বাদক।
ইয়াসিন খান >>> সেতার বাদক।
কাজী আকবর উদ্দিন সিদ্দিক >>> মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক এবং গণপরিষদ সদস্য।
কিরীট খান >>> সেতার বাদক।
খাদেম হোসেন খান >>> সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত সঙ্গীতজ্ঞ।
খুরশিদ খান >>> সংস্কৃতিতে স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত সঙ্গীতজ্ঞ।
ফজল শাহাবুদ্দীন >>> একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত কবি।
ফুলঝুরি খান >>> স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্ত যন্ত্রসঙ্গীত এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী।
বাহাদুর হোসেন খান >>> উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার এবং সরোদ বাদক।
মনমোহন দত্ত >>> মলয়া সঙ্গীতের জনক এবং মরমী সাধক।
মীর কাশেম খান >>> একুশে পদক প্রাপ্ত সেতার বাদক, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক।
মোফাজ্জল হোসেন >>> বীর প্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
মোবারক হোসেন খান >>> একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত সঙ্গীত গবেষক এবং লেখক।
রিনাত ফৌজিয়া >>> সেতার বাদক।
শামসুল হক >>> বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শাহজাহান সিদ্দিকী >>> বীর বিক্রম খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা।
শাহাদাত হোসেন খান >>> একুশে পদক প্রাপ্ত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সরোদ বাদক এবং সুরকার।
শেখ সাদী খান >>> জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত সঙ্গীত পরিচালক এবং সুরকার।
সুফী জুলফিকার হায়দার >>> একুশে পদক প্রাপ্ত কবি।
হাবিবুল্লাহ খান >>> প্রাক্তন তথ্য ও বেতার মন্ত্রী।
আকবর আলি খান >>> অর্থনীতিবিদ;
সালেহউদ্দিন আহমেদ >>> অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
গোলাম আজম >>> রাজনীতিবিদ;
আলী যাকের >>> নাট্য ব্যক্তিত্ব;
আলমগীর >>> অভিনেতা;
শফিক রেহমান >>> সাংবাদিক;
উপজেলার নামকরণ ও ইতিহাস
ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার নবীনগর একটি প্রাচীন জনপদ। বৌদ্ধ যুগে এই এলাকা ছিল সমতট রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। পরবর্তী সময় মুসলিম শাসনকালে ৩টি পরগনায় বিভক্ত ছিল বর্তমান নবীনগর উপজেলা। নবীনগর হতে দক্ষিণ মুখী প্রবাহিত বুড়িনদীর (তিতাস নদীর শাখা) পূর্ব অংশ ছিল নুরনগর পরগনাভুক্ত, পশ্চিম অংশ ছিল রবদাখাত পরগনার্ভুক্ত এবং উত্তর দিকে মেঘনা ও তিতাস পারের অংশ ছিল শাহবাজপুর জনপদের সরাইল পরগনা।
নবীনগর নামকরণ নিয়ে ভিন্ন মতবাদ রয়েছে। তবে ইংরেজ শাসনামলে ভারত বর্ষের প্রথম ম্যাপ রোনাল্ড রে প্রণীত মানচিত্রে নবীনগরের নাম গুরুত্বের সাথে উল্লেখ থাকায় এর প্রাচীনত্ব প্রমাণিত হয়। নামকরণ নিয়ে দুটি ধারার জনশ্রুতির প্রচলন রয়েছে। প্রথম ধারার জনশ্রুতি অনুসারে প্রাচীনকালের জনৈক নবীন চন্দ্র নামক রাজার নামানুসারে নবীন এবং গড় শব্দের অপভ্রংশ থেকে গর-নবীনগর নাম করণ হয়েছে।
কিন্তু এ এলাকার প্রাচীন ইতিহাসে নবীন চন্দ্র নামে কোন রাজা এমনকি জমিদারেরও সন্ধান পাওয়া যায়নি বলে এ জনশ্রুতি মেনে নেয়া যায় না। অন্যদিকে দ্বিতীয় ধারার জনশ্রুতি অনুসারে মুসলিম শাসনামলে ঈদে মিলাদুন্নবীর দিন নবী এবং নগর দুটি শব্দের সংমিশ্রনে নবীনগর নাম করণ করা হয়েছে। তুলনামূলকভাবে দ্বিতীয় ধারার জনশ্রুতির স্বপক্ষে সত্যতা পাওয়া যায়।
নবীনগর নামকরণ নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে । নবীনগর নামকরণের । ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করার পূর্বে কিছুটা পেছনে যেতে হচ্ছে । কিংবদন্তি আছে , ১০৫০ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সরাইল , দাউদপুর , নূরনগর ও বলদাখাল পরগনা কালিদহ সাগরের অংশবিশেষ ছিল । সে সময় পাটিকারা , গঙ্গামণ্ডল , লৌহগড়া ও চান্দিনার । সমতলভূমি আবাসযােগ্য ও জনবসতিপূর্ণ ছিল । জনশ্রুতি আছে , চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙ্গা বা সওদাগরি জাহাজ এই কালিদহ সাগর দিয়ে সিলেট ও ময়মনসিংহের বাণিজ্যিক এলাকায় পণ্যসম্ভার ক্রয় – বিক্রয়ে ব্যস্ত ছিল ।
বিখ্যাত ভূমি জরিপকারী জেমস । রেনেল ( ১৭৬৪ – ‘ ৭৬ ) মানচিত্রে বলদাখাল পরগনা , নূরনগর পরগনাসহ এই অঞ্চলের কিছু কিছু গ্রামের নাম পাওয়া যায় । সেই হিসেবে এই এলাকাটি যে বড় এলাকা ছিল । এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় । | ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে শিবপুরে প্রাপ্ত বিষ্ণুমূর্তির নামফলকের ইতিহাস থেকে অবগত হওয়া যায় যে , ( ৯৮৮ – ১০৩৮ খ্রিস্টাব্দ ) এই অঞ্চলের সমতট রাজ্যের শ্রী মহিপাল দেবের রাজত্ব ছিল । শ্ৰী মহিপাল এর রাজত্বের পরই এই এলাকায় শ্রী নবীনপাল দেব নামে এক পাল বংশীয় শাসকের জনশ্রুতি রয়েছে । কেউ কেউ মনে করেন , ঐ শাসকের নামানুসারেই এ অঞ্চলটি হলাে নবীনপাল দেব এর এলাকা বা নবীনগর যা । পরবর্তী পর্যায়ে আধুনিক নবীনগর ।
কেননা , যেহেতু এই অঞ্চলটি কালিদহ সাগরের তলদেশ থেকে ধীরে ধীরে চর জেগে বহুকাল ধরে একটি বসতি স্থাপনের যােগ্য হয়েছে । সেক্ষেত্রে এটি নিঃসন্দেহে বড় এলাকা । সে হিসেবে ‘ নবীন ’ ও ‘ গড় ‘ এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে পরবর্তীকালে লােকমুখে উচ্চারিত হয়েছে নবীনগর । এ রূপান্তর হওয়ার বিষয়টি অমূলক নয় বলে মনে হয় । আবার বলা যায় যে , এই অঞ্চলের হিন্দুত্ববাদের পতন ঘটিয়ে মুসলিম বীর সেনাপতি ইখতিয়ারউদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি উওর বাংলা বিজয়ের পর এ অঞ্চলে সেনাপতি প্রেরণ করেন এবং কোনাে এক মুসলিম শাসক এসে নবীনগর – এর সৃষ্টি করেন । বিষয়টি আরও ব্যাপকভাবে গবেষণার দাবি রাখে ।
আবার কেউ কেউ বলেন , নবীর নামে এই নবীনগর । কখনাে কোনাে কালে এখানে কে ন কোনাে নবী এসেছিল তা কেউ বলতে পারে না । তবে এখানে নবী না এলেও এখানে অসংখ্য সুফি আউলিয়ার পদচারণা ছিল | কালের সাক্ষ্য হিসেবে বার আউলিয়া বিল এখনাে দৃশ্যমান হয়ে আছে । ফলে সুফি – আউলিয়াদের দ্বারাও এ অঞ্চলের সমছি হয়েছে বলে প্রমাণ পাওয়া যায় । উল্লেখ করা যায় , বরকন্দাজ তাউলিয়া , শেখ সাদী সফী , ছানাউল্লাহ ( র . ) আধ্যাত্মিক পুরুষের প্রভাব এ অঞ্চলে অস্বীকার করা যায় না । এ ছাড়াও নবীনগর নামকরণ ব্যাপারে আরও একটি তথ্য পরিবেশ করা যায় , ঈদ – ই মিলাদনবীর দিনে এ অঞ্চলে নতুন শাসকের উদ্ভবের সুবাদে এ অঞ্চলটির নামকরণ হয় নবীনগর । সম্প্রতি নবীনগর শব্দের বানান রীতিতেও নবিনগর ‘ । “ ই ‘ কার এর পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে ।
একটি কথা সর্বজনস্বীকৃত আধুনিক নবীনগরের নামকরণে এই এলাকায় বিভিন্ন মহলে অল্প বিস্তর নানা জনশ্রুতি থাকলেও , প্রকৃতপক্ষে বলা যায় যে , বলদাখাল বা বরদাখাত পরগনার জমিদার বেগম রওশন আরার কর্মচারী সীতারাম পােদ্দার ওই জমিদারির এক অংশ ক্রয় করে নবীনগরের গােড়াপত্তনে সচেষ্ট হন বিধায় তারই বংশধর নবীন পােদ্দার – এর নামকরণ থেকেই নবীনগর নামকরণ হয়েছে বলে মনে করেন ।